—প্রতীকী চিত্র।
অতিমারি পরিস্থিতি সামাল দিতে কালঘাম ছুটছে গোটা বিশ্বের। তার মধ্যেও ক্ষমতাশালী দেশগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা অব্যাহত। তবে করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুমিছিল রোখার চেয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াইটাই যেন বেশি করে চোখে পড়ছে। ভারতও সেই দৌড়ে শামিল। কিন্তু তার আগে রাশিয়া করোনার টিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে বলে দাবি করায়, দোটানায় পড়েছে ভারত। অবিশ্বাস্য রকমের কম সময়ে তৈরি হওয়া এই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তাই দেশে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়তে থাকলেও, দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির মতো রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনার সাহস পাচ্ছে না ভারত।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের ঘোষণা করে রুশ সরকার। মহাকাশে তাদের পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহের নামেই ভ্যাকসিনের নাম ‘স্পুটনিক’ ভি রাখা হয়েছে বলে জানানো হয়। সরকারি ভাবে প্রথম বার তাঁর মেয়ের উপরই প্রতিষেধকটি প্রয়োগ করা হয়েছে বলেও জানান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আসন্ন অক্টোবর থেকেই জনসাধারণের মধ্যে ওই টিকা প্রয়োগ করা হবে বলে জানিয়ে দেন সে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিখাইল মুরাশকো। কিন্তু বিশ্বের তাবড় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, করোনার প্রতিষেধক নিয়ে কোনওরকম তাড়াহুড়ো না করাই উচিত।
হেলথকেয়ার গ্লোবাল (এইচসিজি)-এর প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর তথা বেঙ্গালুরুতে কোভিড চিকিৎসায় যুক্ত বিশাল রাও বলেন, ‘‘কিছু কিছু টিকা তৈরি করতে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রুত গোটা প্রক্রিয়া শেষ করে ফেলতে চাইছেন নির্মাতারা। কিন্তু সাধারণ মানুষের উপর তা প্রয়োগ করার আগে নিশ্চিত করতে হবে যে এতে কোনও ঝুঁকি নেই।’’ ছাড়পত্র পাওয়ার আগে যে কোনও টিকা বা প্রতিষেধককে চারটি ধাপে পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। রাশিয়ার ‘স্পুটনিক ভি’ এখনও পর্যন্ত তার মধ্যে দু’টিতেই উতরেছে বলে জানা গিয়েছে। সেই প্রসঙ্গে বিশাল রাও বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত ৭৬ জনের উপর ওই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। মোট চারটি ধাপে টিকাটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে হবে। তার জন্য হাজার হাজার রোগীর উপর তা প্রয়োগ করা প্রয়োজন।’’
আরও পড়ুন: বিচারপতি, বিচারব্যবস্থা নিয়ে টুইট, সুপ্রিম কোর্টে দোষী সাব্যস্ত প্রশান্ত ভূষণ
বিশেষজ্ঞরা জানান, টিকা বা প্রতিষেধক তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে তা পশুদের উপর প্রয়োগ করা হয়। দেখা হয় তাদের শরীরে টিকার কী প্রভাব পড়ে। তার ফলাফল ইতিবাচক হলে তবেই প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকদের উপর টিকাটি পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করে দেখা হয়। টিকা প্রয়োগের পর তাঁদের শরীরে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, নজর রাখতে হয় সে দিকে। তাতে যদি উতরে যায় সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়। টিকা প্রয়োগের পর মানবশরীরে কী কী সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে দেখা হয়, মানবশরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ওই টিকার ভূমিকা কী।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই তৃতীয় পর্যায়টিই সবচেয়ে দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এই পর্বে মানবশরীরে টিকার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তৃতীয় পর্বের পরীক্ষা শেষ হতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এই তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শেষ হলেই বাজারে ওই টিকার বিক্রি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু তার পরেও চতুর্থ পর্যায়ের পরীক্ষা চালিয়ে যান গবেষকরা। সে ক্ষেত্রে মানবশরীরে টিকাটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব খতিয়ে দেখা হয়। তার জন্য একটা বড় অংশের মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করা হয় প্রতিষেধকটি।
করোনা চিকিৎসক বিশাল রাওয়ের দাবি, মানবশরীরে টিকা প্রয়োগের পর যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, এক বছর পর্যন্ত সেটির টিকে থাকা উচিত। ‘স্পুটনিক ভি’-এর ক্ষেত্রে তা এখনও প্রমাণ হয়নি। যে সমস্ত করোনা রোগীর কোমর্বিডিটি রয়েছে এবং যাঁরা বয়স্ক, তাঁদের উপরই বা এর প্রভাব কী, তা-ও জানা যায়নি এখনও পর্যন্ত। তিনি আরও বলেন, ‘‘সবকিছু মাথায় রেখে নাগরিকদের আরও সতর্ক হওযা প্রয়োজন। এখনই রুশ টিকার কার্যক্ষমতা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব নয়। তবে আশা করা যায়, যিনি বা যাঁরা করোনার টিকা তৈরিতে হাত লাগিয়েছেন, তাঁরা অতিমারি পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানকে পাথেয় করেই চলছেন, নাকি রাজনীতিকে।’’
আরও পড়ুন: গভীর কোমায় চলে গেলেন প্রণব, রয়েছেন ভেন্টিলেশনেই
‘স্পুটনিক ভি’ নিয়ে রাশিয়ার তরফে এখনও পর্যন্ত যে তথ্য সামনে আনা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ১২ অগস্ট থেকে দেশে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। রাশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা দেশ থেকে ২ হাজারের বেশি মানুষের উপর এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু ওই টিকা নিয়ে রাশিয়ার তরফে বিশদে কিছু না জানানোয় উদ্বিগ্ন গবেষকরা। রুশ সরকারের ওয়েবসাইটে দু’টি পর্যায়ে টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা জানানো হলেও, তার ফলাফল খোলসা করা হয়নি। এখনও যত জনের উপর টিকা পরীক্ষা করা হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেককে দু’টি করে ডোজ দেওয়া হয়েছে এবং টিকা নেওয়ার পর তাঁদের মধ্যে জ্বর, মাথাব্যথা এবং চুলকানির মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে বলে জানিয়েছে রাশিয়া।
অন্যান্য টিকার ক্ষেত্রে এই ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও, করোনার টিকা হাতে পেতে এখনও অপেক্ষা করতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাই ব্রিটেন, কানাডা, আমেরিকার মতো দেশ ইতিমধ্যেই রাশিয়ার আবিষ্কৃত টিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। ফিলিপিন্সের মতো দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশ এ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলেও, রাশিয়ার টিকা আবিষ্কারে ভারতের আখেরে কোনও লাভ হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, রাশিয়ার আবিষ্কৃত টিকা কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে দিল্লিরও।