দিল্লি থেকে বাড়ির পথে পরিযায়ী শ্রমিকেরা। মঙ্গলবার। ছবি: প্রেম সিংহ
করোনার মতোই রাজধানীতে সংক্রামক হয়ে উঠল আতঙ্কের স্মৃতি। এক বেলা খেয়ে পরের দিনের জন্য চাল়-ডাল বাঁচানোর স্মৃতি। মাইলের পর মাইল জাতীয় সড়ক ধরে হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি। বাড়ি পৌঁছতে না পেরে পথিমধ্যে মৃত্যুর স্মৃতি।
এ বারে তাই আর বিলম্ব নয়। গত বছরের পুনরাবৃত্তি আর হতে দিতে চান না ভিন্ রাজ্য থেকে আসা দিন-আনা, দিন-খাওয়া শ্রমিককুল। রাজধানীতে ছ’দিনের লকডাউন ঘোষণার পরই দিল্লির রেলস্টেশন, আনন্দবিহার বাস টার্মিনাসে উপচে পড়ছে ভিড়। রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী যদিও তাঁদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন, রেলমন্ত্রীর অভয়, ‘‘রেল চলবে।’’
তাড়া খাওয়া মানুষের মুখে যে ত্রাস লেগে থাকে, তা কিন্তু এই আপ্তবাক্যে বদলাচ্ছে না। যেমন দক্ষিণ দিল্লির কালকাজিতে মিস্ত্রির কাজ করা বছর পঁচিশের যুবক আফতাব হুসেন। যে ভাবে হোক ফিরতে চান ধানবাদে। বলছেন, ‘‘গত বছর এই দিল্লিতেই পর পর তিন দিন একবেলা খাবারও জোটেনি। সামান্য ছাতু খেয়ে টেনেছি। তার পর চেয়েচিন্তে ডাল-আটা কখনও এসেছে, কখনও নয়। এ বার আর নয়। যে ভাবে হোক ফিরে যাব।’’
কিন্তু এ বার লকডাউন তো ছ’দিনের? ভয়ার্ত কণ্ঠ বলল, ‘‘গত বার মোদীজী ২১ দিন বলে তার পর আরও সপ্তাহের পর সপ্তাহ লকডাউন করে রেখেছিলেন। আপনি বলতে পারেন, এ বারেও তা হবে না? মরলে বাড়িতে গিয়ে মরব।’’
নরেন্দ্র মোদীর অবশ্য আশ্বাস, লকডাউন শেষ অস্ত্র। এ বারে তার প্রয়োগ করার দরকার হবে না বলেই তাঁর বিশ্বাস। পরিযায়ীদের প্রতি তাঁর আবেদন, ‘‘যে যে শহরে আছেন, থাকুন। প্রতিষেধকও পাবেন, কাজও বন্ধ হবে না।’’ শ্রমিকদের ভরসা জোগানো আর টিকা দেওয়ার কাজে তিনি এগিয়ে আসতে
অনুরোধ করেছেন রাজ্য সরকারগুলিকে। ১৮ বছর বয়স হলেই টিকা দেওয়ার যে নীতি, তা কার্যকর করার দায়ও রাজ্যেরই। কারণ ওই টিকা কেন্দ্র জোগাবে না। কিন্তু পরিযায়ীদের বাড়ি ফেরার ঢল আটকাতে আজ মোদী জোর দিলেন টিকাকরণেই। লকডাউন না করে রাজ্য সরকারগুলিকে বললেন, শ্রমিকদের বোঝাতে।
অথচ আনন্দ বিহার বাস স্ট্যান্ডের আজ এবং গত কালের ছবিটা কিন্তু মনে পড়িয়ে দিচ্ছে গত বছরের নিষ্ঠুর এপ্রিলকেই। জামলো মাকদম নামে সেই বাচ্চা মেয়েটির মৃত্যু পর্যন্ত হেঁটে যাওয়াকেই। লোটাকম্বল নিয়ে এই যে দীর্ঘ লাইন, তাদের কেউ পৌঁছতে চান উত্তরপ্রদেশ, কেউ বিহার, কেউ ঝাড়খণ্ড। গন্তব্য পৃথক। কিন্তু বক্তব্য একটাই। ‘‘আমরা আবার আটকে পড়তে চাই না।’’
এই আতঙ্ক কমানোর জন্য দিল্লি এবং কেন্দ্রীয় সরকারি মেকানিজম অবশ্য পুরোদমে চালু। রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রশ্ন করা হলে তিনি আশ্বস্ত করার সুরে বলেন, ‘‘চিন্তার কোনও কারণ নেই। প্রথমত দেশজোড়া কোনও লকডাউন হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও খোঁজ নিয়ে দেখেছি, কোনও স্টেশনেই বিরাট কোনও ভিড় নেই। বরং ট্রেন খালি যাচ্ছে। যদি প্রয়োজন হয়, আমরা স্পেশাল ট্রেনও চালাব। কিন্তু তার প্রয়োজন হবে না।’’
গত কাল লকডাউন ঘোষণার পরেই পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে আবেদন করেছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। বলেছিলেন, ‘‘আমি আপনাদের কাছে হাতজোড় করে প্রার্থনা করছি, এটা ছোট লকডাউন। দয়া করে দিল্লি ছেড়ে যাবেন না।’’ কিন্তু তাতে শান্ত হচ্ছে না শ্রমিকদের মন। তাঁদের বক্তব্য, গত বছর প্রধানমন্ত্রী যেটা করেছিলেন, এ বছর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীও সেই একই কাজ করলেন। কোনও সময় না দিয়েই লকডাউন করে দিলেন।
সরকারকে দুষে মুখ খুলছেন বিরোধী নেতারাও। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী বলেছেন, ‘‘পরিযায়ী কর্মীরা আরও একবার পালাচ্ছেন। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব ওঁদের ব্যাঙ্কের খাতায় টাকা জমা করার। কিন্তু করোনা ছড়ানোর জন্য সাধারণ মানুষের ঘাড়ে দোষ চাপানো সরকার কি এই ধরনের জনসহায়ক পদক্ষেপ করবে?’’ তৃণমূলে যোগ দেওয়া প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যশবন্ত সিনহার কথায়, ‘‘একবার তোমরা ভুল করতে পারো। কিন্তু বারবার করলে বলতে হয় তুমি মূর্খ। কেন্দ্রীয় সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে ঠিক একই কাজ করছে।’’ দিল্লি হাইকোর্টের তরফেও কেন্দ্র এবং দিল্লি সরকারের সমালোচনা করে বলা হয়েছে, তারা পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্কট মেটাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।