—প্রতীকী ছবি।
এ বার কী হবে? গৃহকর্মে সাহায্য-সঙ্গীকে আগাম বেতন দিয়ে বাড়িতে খিল তুললাম। লকড ইন।
এই অঞ্চলে যুবক বলতে আমরা ষাটোর্ধরাই দলে ভারী। সকাল আটটা না রাত আটটা তা বোঝা যায় আয়া বাহিনীর স্রোতে। কদিন ধরে আর সেই আওয়াজ নেই। অথচ বেশির ভাগ বাড়িতে আশি পেরোনো আয়া নির্ভর অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। সহায়ক ছাড়া তাঁদের গতি নেই। বাড়ির সামনে সব্জির গাড়ি না এলে হেঁসেল চলে না। কী হবে এঁদের?
তবুও বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতির বিরোধী আমি এই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হল কেন এক সপ্তাহ আগেই এটা হল না! একই সঙ্গে মাথায় এল শাঁখের করাতের কথা। অন্তরীণ থেকে করোনার প্রকোপ কমবে! কিন্তু জঠরের জ্বালা? যে দিকেই যাই কাটবেই।
আরও পড়ুন: কান ধরে ওঠবোস, লাঠিপেটা করে ‘লকডাউন’ করল পুলিশ, বাহবা আমজনতার
নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। যেমন জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবশ্রী রায় ও তাঁর কোভ-ইন্ড স্টাডি গ্রুপের সঙ্গীরা যা বলছেন তাতে তো দুশ্চিন্তা বাড়ছে। তাঁদের অঙ্ক অনুযায়ী, এই দেশ যদি ঝাঁপিয়ে না-পড়ে, তা হলে ১৫ মে-র মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৫৮ হাজার ৬৪৩ ছাড়িয়ে যাবে। তাঁরা বলছেন এই হিসাবও নেহাতই রক্ষণশীল।
আরও চিন্তার কারণ হল, তাঁদের অঙ্ক বলছে ভারতে করোনার প্রকোপ ছড়ানোর প্রবণতা আমেরিকার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। ওই দেশে যা হচ্ছে আমাদের এখানে তাই হচ্ছে ১৩ দিন বাদে।
কিন্তু এটা প্রাথমিক স্তরের হিসাব। একবার ছড়াতে শুরু করলে আক্রান্তের সংখ্যা ঠেকানো এ দেশের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন উঠে গিয়েছে। বিনা চিকিৎসাতেই কত মারা যাবে তার হিসাব করা মুশকিল। কারণ, আমাদের দেশে প্রতি ১০০০ মানুষ পিছু হাসপাতালের বেড রয়েছে মাত্র ০.৭টি। দক্ষিণ কোরিয়া— করোনা যুদ্ধের মডেল হিসাবে পরিচিত— এই যুদ্ধ শুরু করেছিল প্রতি হাজারে ১১.৫টি বেড নিয়ে। আরও আছে। আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত ৪০ হাজার ভেন্টিলেটর আছে। আর আমরা কথা বলছি আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষ ছাড়ানোর আশঙ্কা নিয়ে।
আরও পড়ুন: করোনার এই অন্ধকারে আলোর রেখা পড়ছে যে সব জায়গা থেকে
এ রকম নয় যে হাল ছেড়ে দিয়েছে সবাই। মহীন্দ্রা মোটরস-এর আনন্দ মহীন্দ্রা ইতিমধ্যেই ঘোষণ করেছেন তাঁর কারখানায় ভেন্টিলেটর বানানোর সিদ্ধান্তের কথা। মার্কিন দেশের ফোর্ড মোটরস-এর রাস্তায় হেঁটেই। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবাণু প্রতিরোধক পোশাক! ইউরোপে ত্রাহি ত্রাহি চলছে এই পোশাকের অপ্রতুল সরবরাহ নিয়ে। মাস্ক না হয় রিলায়েন্স বানাবে বলেছে। কিন্তু এই পোশাক?
সংশয় আরও বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি স্বীকার করে নিয়েছেন আমাদের পক্ষে এই লড়াই লড়াটাই কতটা দুষ্কর। যে দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ছাগল চড়ে স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে, সেই দেশে এই লড়াইকে কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। এবং তা যে কতটা অসম্ভব তা অনুমান করতে বিরাট কিছু পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই।
ভেন্টিলেটরের কথাই ধরুন। এই ৪০ হাজারের বেশির ভাগই বিভিন্ন শহরের হাসপাতালে রয়েছে। গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এর ব্যবহার আমরা কল্পনাই করতে পারি না। এ বার যদি ধরেও নিই আমরা পারলাম যথেষ্ট সংখ্যক ভেন্টিলেটর তৈরি করতে, তা বসানো হবে কোথায়? চালাবে কে? সেই সংখ্যক প্রশিক্ষিত কর্মীই বা কোথায়?
কোরিয়া ব্যবহার করেছে টেন্টের মতো কেবিন। গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে আক্রান্তকে অন্তরীণ করে রাখার জন্য। ইউরোপেও চেষ্টা চলছে একই রাস্তায় হাঁটার। কিন্তু আমাদের দেশে কি তা সম্ভব। এর ব্যবহারে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে তো সেই অপ্রতুল স্বাস্থ্যকর্মী।
আরও পড়ুন: লকডাউনে অ্যাম্বুল্যান্স মেলেনি, পুলিশভ্যানেই সন্তানের জন্ম সোনারপুরে
ভাবনাটা পাক দিয়েই চলেছে। এক অসহায়তা যা হয়ত বহু আগেই দূর করার রাস্তায় হাঁটতে পারতাম। কিন্তু রাজনৈতিক আকচাআকচিতে আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সময়ের নিরিখে পিছিয়েই থাকল। এই সব ভাবতে ভাবতেই মনে এল আমাদের বাড়ির কাজে সাহায্যসঙ্গী অনিমার প্রলাপ। “আমরা তো দিন আনি দিন খাই। সবাই সব বন্ধ করে দিলে খাব কী?” ওর ছেলেরাও একই ভাবে আয় করে।
আমাদের দেশে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ৪৭.৪১ কোটি মানুষ কোথাও না কোথাও কাজ করে আয় করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে ৩৩.৬৯ কোটি কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাজ করেন। এই ৩৩.৬৯ কোটির মধ্যে আবার ১১ কোটির একটু বেশি বাঁচেন দৈনন্দিন আয়ের ভরসায়। এক দিনের আয়েই যাঁদের পেট ভরে না, তাঁরা ২১ দিন আয় না-করে বাঁচবেন কী ভাবে? আমরা জানি না।
৮৬ বছরের মা কাঁধ ভেঙে অস্ত্রোপচারের পর বাড়িতে সুস্থ হচ্ছেন। আয়াকে রেখে দিয়েছি। কিন্তু ইতিমধ্যেই ওষুধের আকাল শুরু হয়েছে। যিনি ওষুধ সরবরাহ করেন তিনি আটকে গিয়েছেন। অন্য দোকানে অন্য সমস্যা। কোথাও সরবরাহ আছে তো তা ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার লোক নেই। কোথাও লোক থাকলে ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার মতো সব ওষুধ নেই।
আমাদের আশেপাশেই প্রচুর বাড়ি আছে যেখানে অশক্ত বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা আয়ার ভরসায় থাকেন। তাঁদের ওষুধ আগে দোকান থেকে দিয়ে যেত। এখন দোকানে লোক নেই। কী হবে এঁদের? হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেও চাপ। মাকে নিয়ে সেলাই কাটাতে গিয়েছিলাম এক প্রখ্যাত হাসপাতালে গত সোমবার। ওপিডি-তে হুইল চেয়ার ঠেলার কর্মী একজনই। অগত্যা ঠেলতে হল আমাকেই।
এই অবস্থার গুরুত্ব কি আমরা বুঝছি? অস্ট্রেলিয়ায় এবং আমেরিকায় দেখলাম মানুষজন সমুদ্র সৈকতে আমোদে ব্যস্ত। আমরাই বা কম যাই কিসে? খাওয়ার আছে। থাকবেও। দোকানে ভিড় করে লাভ নেই। মাথায় রাখুন শুধু ৪০ হাজার ভেন্টিলেটরের কথা। মাথায় রাখুন কয়েক কোটি অভুক্তের কথা। না-হয় এ বার ‘কী হবে’ থেকে বেরিয়ে ভাবি ‘কী করব’! বাঁচার রাস্তা খোঁজাটা কিন্তু এখন খুবই জরুরি।