করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় ব্যস্ত ডাক্তাররা।
করোনা নিয়ে বাড়ছে আশঙ্কা আর উদ্বেগ। এই আবহেই ঘুরে ফিরে উঠে আসছে, সংক্রমণ ঠেকানোর নানা উপায়ের কথা। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ‘কঠোর ভাবে রোগ দমন’-এর কথা চিন্তা ভাবনা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। উঠছে ‘ভিলওয়াড়া মডেল’-এর কথা। ইতিমধ্যে ওই মডেলের কথা বলেছেন ক্যাবিনেট সচিব রাজীব গৌবাও। রাজস্থানের ওই জেলায় করোনা সংক্রমণ থামাতে যে যে পদক্ষেপ করেছে প্রশাসন তার সাফল্য বিভিন্ন মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কী সেই সাফল্য? দেশের যে এলাকায় করোনা সংক্রমণ বেশি সেই তালিকায় রয়েছে ভিলওয়াড়া জেলাও। গত ১৯ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ, এই সময়সীমার মধ্যে রাজস্থানের ওই জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২৬। কিন্তু ৩০ মার্চের পর থেকেই সংক্রমণ বৃদ্ধির গ্রাফ নিম্নমুখী। মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র এক জন নতুন করে করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। মোট ২৭ জন রোগীর মধ্যে ১৭ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন এখন।
করোনা দমনে রবিবার বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যসচিবদের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্স করেন ক্যাবিনেট সচিব। সে সময় ‘ভিলওয়াড়া মডেল’-এর কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর মতে, করোনা রুখতে ‘ভিলওয়াড়া মডেল’-এর প্রয়োগ করে রোগ দমন অথবা হাসপাতাল এবং কোয়রান্টিন সেন্টারের মতো পরিষেবা গুলি বাড়ানো। সূত্রের খবর, দেশে করোনার অন্যান্য হটস্পটগুলিতেও প্রয়োগ করা হতে পারে ‘ভিলওয়াড়া মডেল’। অনেকেই মনে করছেন, বাস্তবিক অর্থেই গেম চেঞ্জার হয়ে উঠতে পারে এই মডেল।
আরও পড়ুন: খুব বিপদে পড়া দেশে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পাঠানো হবে: বিদেশমন্ত্রক
ভিলওয়াড়ায় কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ে করোনা? রাজস্থানের ওই জেলায় প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে ১৯ মার্চ। এক বেসরকারি হাসপাতালের এক জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যেই ওই জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যাটা দ্রুত বেড়ে যায়। আক্রান্তদের বেশিরভাগই ছিলেন ওই হাসপাতালের কর্মী অথবা সেখানে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। এর পরই রোগ দমনে পদক্ষেপ করে ভিলওয়াড়া প্রশাসন যা কার্যত গোটা দেশের কাছেই এখন মডেল হয়ে উঠেছে।
কী এই ভিলওয়াড়া মডেল?
একাধিক সংক্রমিত ধরা পড়ার পর, রাজস্থানের ওই জেলা কার্যত হটস্পট হয়ে উঠেছিল। এর পরই করোনা দমনে একাধিক ব্যবস্থা নেয় জেলা প্রশাসন। তাই পরবর্তী কালে ‘ভিলওয়াড়া মডেল’ হয়ে উঠেছে।
• প্রাথমিক ভাবে গোটা ভিলওয়াড়া জেলাকেই কার্যত বিচ্ছিন্ন করা হয়। প্রথম করোনা আক্রান্তের হদিশ মেলার পরই জেলা জুড়ে কার্ফু জারি করা হয়। ২০ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত চলে কার্ফু। ওই সময় অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, জেলায় ঢোকা ও বার হওয়ার সমস্ত পথ ও সীমানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রেলপথও বন্ধ করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফার কার্ফুর সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ৩ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। ভিলওয়াড়ার জেলাশাসক রাজেন্দ্র ভাট দাবি করেছেন, এই সময়ে জেলা প্রশাসনের তরফে প্রত্যেক বাড়িতে শাকসব্জি, ফল ও দুধের যোগান দেওয়া জারি হয়েছে।
• দ্বিতীয় পদক্ষেপে সেই বেসরকারি হাসপাতালটিকে চিহ্নিত করা হয়, যেখানকার চিকিৎসক ও কর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। উৎসস্থল থেকে ১ কিমি পরিধি জুড়ে রোগ দমন এলাকা (কনটেনমেন্ট জোন) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আরও তিন কিমি বাফার জোন হিসাবে ধরা হয়। ঠিক একই পদ্ধতিতে করোনা আক্রান্ত রোগীর বাড়ির চারপাশে এক কিমি জুড়ে কনটেনমেন্ট জোন ও তিন কিমি জুড়ে বাফার জোন তৈরি করা হয়। ওই সব এলাকায় রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে নামানো হয় বিশেষ দল। করোনার জন্য নির্দিষ্ট একটি হাসপাতালে পরীক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। করোনার উপসর্গ দেখা দিলে সরকারি গাড়িতেই ওই কেন্দ্রে রোগীদের আনা হত।
নির্জন ভিলওয়াড়ার রাস্তাঘাট। ছবি: পিটিআই
• জেলা প্রশাসন এলাকার ২৭টি হোটেলের ১ হাজার ৫৪১টি ঘরকে কোয়রান্টিন সেন্টার হিসাবে গড়ে তুলেছে। এ ছাড়াও ২২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হস্টেলে তৈরি রাখা হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার কোয়রান্টিন বেড।
• শহর ও গ্রামীণ এলাকায় নিয়োগ করা হয়েছিল ‘করোনা ফাইটার’ ও ‘করোনা ক্যাপ্টেন’দের। শহরে ‘করোনা ক্যাপ্টেন’-এর ভূমিকায় কাজ করছেন মহকুমা শাসক। আশা কর্মী ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীরা কাজ করছেন ‘করোনা ফাইটার’ হিসাবে।
• গ্রামে ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার (বিডিও) এবং তহসিলদারদের পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ‘করোনা ফাইটার’ হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়াও, পঞ্চায়েত প্রধান, পঞ্চায়েত সহায়ক এবং আশাকর্মীদের ‘করোনা ফাইটার’ হিসাবে নিয়োগ করা হয়।
আরও পড়ুন: সঙ্কটজনক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, সরানো হল আইসিইউতে
করোনার প্রভাবে নাস্তানাবুদ গোটা দুনিয়া। হু হু করে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে আমেরিকা, ইটালি, স্পেন, জার্মানি-সহ বিভিন্ন দেশে। দিন দিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। সারা দেশে করোনায় আক্রান্ত চার হাজারের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে রাজস্থানেই দুশো আশি জনের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এই অতিমারি দমনে আশার আলো দেখাচ্ছে রাজস্থানের ভিলওয়াড়া। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এই যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি রাজস্থানের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব (স্বাস্থ্য দফতর) রোহিতকুমার সিংহ। তাঁর দাবি , সময় নষ্ট না করেই, ৭ হাজার দল গঠন করা হয়েছিল। খুব কম সময়ে ২০ লক্ষ স্থানীয় মানুষের উপরে সমীক্ষা চালায় ওই দলগুলি। ফ্লুয়ের উপসর্গ দেখলেই স্ক্রিনিং করা হত।