বেরোনো বারণ। পোস্টার নিয়ে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী। পিটিআই
রবিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণার পরে সোমবার সন্ধ্যা থেকে চার দিনের জন্য ঘরবন্দি থাকার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন রাজ্যের আমজনতা। আজ দুপুরেই লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে ৩১ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত করার কথা ঘোষণা করেন তিনি। কিন্তু বাড়তি চার দিনের জন্য তৈরি হওয়ার আগেই রাত আটটায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়ে দিলেন, মঙ্গলবার রাত বারোটা থেকে ২১ দিনের জন্য ঘরবন্দি থাকতে হবে গোটা দেশকে।
অর্থাৎ, ১৪ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবেন না। ঘরের কোণে নববর্ষ কাটাবে বাঙালি! তার চেয়েও বড় কথা, বিপদে পড়বেন দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষেরা। একা থাকেন এমন বয়স্ক মানুষ বা অসুস্থদের সঙ্কটও কম নয়। তাঁদের জন্য কোনও আশ্বাসবাণী নেই মোদীর বক্তৃতায়।
তিন সপ্তাহ লকডাউনের কারণ ব্যাখ্যা করে আজ জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘করোনা সংক্রমিত অন্যান্য উন্নত দেশের উদাহরণ দেখে এই পদক্ষেপ করা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। এই ২১ দিন সময় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তা না-হলে দেশ ২১ বছর পিছিয়ে যাবে।’’
মোদীর বক্তৃতার পরেই জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন ২০০৫-এর আওতায় লকডাউনের বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ফলে রাজ্যগুলিকেও তা মেনে প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা জারি করতে হবে। তবে রাজ্য চাইলে ছাড়ের আওতায় থাকা জরুরি পরিষেবার তালিকা রদবদল করতে পারে। নবান্নের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, বুধবার প্রশাসনিক স্তরে আলোচনা করে নির্দেশিকা জারি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
গত বৃহস্পতিবার তাঁর বক্তৃতায় দেশের মানুষের কাছে ১৪ ঘণ্টা সময় চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জনতা কার্ফুর ডাক দিয়েছিলেন রবিবার সকাল সাতটা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত। কিন্তু রবিবারের পর থেকে ধীরে ধীরে লকডাউন শুরু হয় বিভিন্ন রাজ্যে। বন্ধ করে দেওয়া রেল চলাচল। শাসক শিবির সূত্রে বলা হয়েছে, রাজ্যগুলিতে লকডাউন হলেও, যে ভাবে লোকে রাস্তায় ঘুরতে বেরিয়েছেন, দোকানের সামনে অহেতুক ভিড় করেছেন, তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা। তাই কড়া সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। মোদী বলেন, ‘‘এর ফলে আমাদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে ঠিকই, কিন্তু মানুষের প্রাণ আগে। তাই আজ রাত বারোটা থেকে ঘরের বাইরে লক্ষ্মণরেখা টেনে দেওয়া হল। যার বাইরে গেলেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’
কেন ২১ দিনের লকডাউন? স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস কোনও ব্যক্তির শরীরে প্রবেশের পর দু’সপ্তাহ পর্যন্ত তার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এই সময়ে কারও শরীরে উপসর্গ দেখা যায়। কারও দেখা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, যাঁদের দেখা যায় না, তাঁদের নিয়েই বেশি ভয়। মোদীর কথায়, ‘‘এমন ব্যক্তিরা সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে হাজারের বেশি লোককে সংক্রমিত করতে সক্ষম।’’
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মতে, যে হেতু এই ভাইরাস মাঝে মধ্যেই মিউটেশনের মাধ্যমে চরিত্র বদলাচ্ছে, তাই ঝুঁকি না-নিয়ে দু’সপ্তাহের পরিবর্তে একবারে তিন সপ্তাহ লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশা, এই লকডাউনের ফলে লোকে রাস্তায় কম বার হবে। সামাজিক দূরত্ব বাড়বে। তাতে এক দিকে যেমন সংক্রমণ রোখা সম্ভব হবে, তেমনই আক্রান্তদের ভাল করে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যাবে।
কিন্তু মোদী যে রকম একতরফা ভাবে লকডাউনের কথা ঘোষণা করেছেন, তাতে অসন্তুষ্ট বিরোধীরা। তাঁদের অভিযোগ, রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা না-করে লকডাউন ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত। রাতে অবশ্য লকডাউন নিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিবদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি কে মিশ্র, ক্যাবিনেট সচিব রাজীব গৌবা এবং স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় ভাল্লা।
প্রশ্ন উঠেছে চার ঘণ্টারও কম সময় দিয়ে ২১ দিনের জন্য লকডাউন জারি করার যৌক্তিকতা নিয়েও। অনেকেই বলছেন, ধাপে ধাপে লকডাউনের সময়সীমা বাড়ালেই ভাল হত। তাতে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াত কম। গরিব মানুষেরা এত দিন লকডাউনের ধাক্কা কী ভাবে সামলাবেন, প্রশ্ন সেটাই। তাঁদের সুরাহা নিয়ে একটি শব্দও নেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়।
গত রবিবারের পর থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। এখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বাড়ানোর জন্যই লকডাউন। কিন্তু মোদীর ঘোষণার পরেই বহু জায়গায় মুদি দোকানের সামনে ভিড় জমে। অনেকেই বলছেন, লকডাউনের ঘোষণা আরও ভাল ভাবে, ঘর গুছিয়ে করা উচিত ছিল। তা না-করায় সামাজিক দূরত্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্য আজ মাঠে মারা গিয়েছে।
মোদী পরে টুইট করেন, ‘এ ভাবে দোকানের সামনে ভিড় করে আপনারা করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ভয় পেয়ে কিছু কেনাকাটা করবেন না। আমি আবার বলছি, কেন্দ্র ও রাজ্য সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জোগান দেবে।’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহেরও টুইট-আশ্বাস, ‘সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করবে। এ ব্যাপারে রাজ্যগুলির সঙ্গে একযোগে কাজ করা হচ্ছে।’
মোদী-শাহ এই দাবি করলেও, লকডাউনের জেরে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হবে বলেই অনেকের আশঙ্কা। বহু বয়স্ক মানুষ একা থাকেন, অনেকে নার্স বা আয়ার উপরে নির্ভরশীল— তাঁদের কী হবে সে প্রশ্নের উত্তর নেই মোদীর ভাষণে। বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য বলছেন, যেমন যেমন সমস্যা দেখা দেবে, তেমন তেমন ভাবে তা নিরসনের চেষ্টা করবে সরকার। অতীতে যেমন নোট বাতিলের সময়ে করা হয়েছিল।
করোনা মোকাবিলার পরিকাঠামো তৈরিতে আজ ১৫ হাজার কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে কেন্দ্র। কিন্তু তা যথেষ্ট নয় বলেই অভিযোগ বিরোধীদের।