Coronavirus in India

সারা রাজ্যে করোনা কমছে, সকলে কিন্তু মানছেন না

কলকাতার হাসপাতালগুলিতে আর করোনা রোগীদের সেই ভিড় নেই। কমেছে করোনা পরীক্ষাও। সমালোচকরা অবশ্য বলছেন, সরকার যথেষ্ট সংখ্যার কোভিড পরীক্ষা করাচ্ছে না।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৮:৫৯
Share:

করোনা পরীক্ষা। -ফাইল ছবি।

চার মাসে অনেকটাই বদলে গিয়েছে ছবি। কিন্তু গিয়েছে কি?

Advertisement

আপাতত দেখা যাচ্ছে, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাংলায় ঝপ করে নেমে গিয়েছে! কলকাতার সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে আর করোনা রোগীদের সেই ভিড় নেই। রোজ করোনা পরীক্ষাতেও চার মাসের আগের চেনা ছবিটা আর দেখা যাচ্ছে না।

অথচ করোনাভাইরাসে রোজ নতুন নতুন আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধিতে চার মাস আগেও সেপ্টেম্বরে ভারত প্রায় সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে আমেরিকার সঙ্গে। কোনও কোনও দিন তো ভারত টপকেও গিয়েছিল আমেরিকাকে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় নতুন কোভিড রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৯,২১৭। ওই দিন ভারতে সংখ্যাটা ছিল ৯০,১২৩। মানে আমেরিকার প্রায় আড়াই গুণ! সে দিন বাংলায় নতুন কোভিড রোগীর সংখ্যা ছিল ৩,২২৭। কলকাতা-সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সেই সময় রোজই উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে চলছিল।

Advertisement

জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকের ছবি পাল্টে গিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা নাটকীয় ভাবে কমেছে। পশ্চিমবঙ্গেও। গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলায় এক দিনে নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল ৩,২২৭। ওই দিন কোভিড পরীক্ষা হয়েছিল ৪৫,২২৬ জনের। আর গত ৩ ফেব্রুয়ারি সেই সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে নাটকীয় ভাবে কমে গিয়ে হয়েছে ২০১। তবে কোভিড পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ২১,৮১২ জনের। প্রায় অর্ধেক।

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা চিকিৎসক অজয় চক্রবর্তী মনে করেন, অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ‘টিম’ হিসাবে কাজ করে চলেছেন পুলিশ, প্রশাসন, নবান্নের স্বাস্থ্য দফতরের অফিসার, জেলা স্তরের স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে চলেছেন আইএমএ-এর বিশিষ্ট চিকিৎসকরা। এমনকি, জেলায় জেলায় ‘আশা’ কর্মীরাও। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে চলেছেন। প্রয়োজনে তাঁরাই কোভিড পরীক্ষার জন্য মানুষকে নিয়ে আসছেন পরীক্ষাকেন্দ্রগুলিতে। কোভিড রোগী কমার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ।অজয়ের কথায়, ‘‘এমন টিম এফর্ট বহু দিন দেখা যায়নি পশ্চিমবঙ্গে। এখনও প্রতি রবিবার রাতে তিন/সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে ওয়েবিনারে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয় পরিস্থিতি মোকাবিলার নতুন নতুন পদ্ধতি নিয়ে।’’

চলছে করোনা টিকাকরণ। -ফাইল ছবি।

মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের চিকিৎসক কুণাল সরকার জানাচ্ছেন, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই করোনা রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে গত সেপ্টেম্বরে অতিমারির পিক পিরিয়ডে যত করোনা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হত, এখন তা অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমে গিয়েছে। ৩০ শতাংশ কমেছে বললেও ভুল বলা হবে না।

সমালোচকরা অবশ্য বলছেন, সরকার যথেষ্ট সংখ্যার কোভিড পরীক্ষা করাচ্ছে না। একটা সময়ে দৈনিক ৪০,০০০ পরীক্ষা করানো হত। এখন তা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। দৈনিক কত পরীক্ষা করানো হচ্ছে, তারও কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে না। সূক্ষ্ম ‘আরটিপিসিআর’ পরীক্ষার বদলে বেশিরভাগ সময়েই র্যায়পিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করানো হচ্ছে। যা অধিকাংশ সময়েই ভুল করে করোনা নেগেটিভ দেখায়।

রাজ্য বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসুর কথায়, ‘‘করোনা পরিসংখ্যান নিয়ে প্রথমদিন থেকেই রাজ্য সরকার কারচুপি করেছে। মৃতের সংখ্যা নিয়ে অডিট কমিটির নামে তথ্য গোপন করেছে। এখন ভোটের আগে ওই প্রবণতা আরও বেড়েছে। পর্যাপ্ত পরীক্ষাই হচ্ছে না! যদিও আক্রান্তের সংখ্যায় বাংলা দেশে এখন তৃতীয়।’’ তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘তথ্য গোপন করে ভোট জেতা যায় না।’’

এই অভিযোগ মানতে রাজি নন রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম। উল্টে তাঁর কথায়, ‘‘নভেম্বরের আগে পর্যন্ত রাজ্যে মোট পরীক্ষানিরীক্ষার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হত আরটিপিসিআর পরীক্ষা। গত তিন/সাড়ে তিন মাসে সেটা বেড়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হয়েছে।’’তা হলে আগে কেন রাজ্যে আরটিপিসিআর পরীক্ষা কম করানো হচ্ছিল? কেনই বা এখন সেটা বাড়ানো হল?স্বাস্থ্যসচিব বলছেন, ‘‘আরটিপিসিআর পরীক্ষার ফলাফল জানতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা লাগে। কিন্তু র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ফলাফল সঙ্গে সঙ্গেই জানা যায়। নভেম্বরের আগে পর্যন্ত কাজের মূল ফোকাসটা ছিল কত তাড়াতাড়ি সংক্রমণ কমানো যায়। তার জন্য জরুরি ছিল র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা। সংক্রমণ আপাতত অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তাই র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার পরিবর্তে আরটিপিসিআর পরীক্ষা বেশি করানো হচ্ছে।’’

রাজ্য সরকারের কোভিড মনিটরিং গ্রুপের মেন্টর চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘কোভিড রোগীর সংখ্যা কমার জন্য যে সব বৈজ্ঞানিক কারণ খোঁজার চেষ্টা চলছে, তার সবই ধারনা। লড়তে লড়তে ভাইরাসটাকে একটু বেশি চিনতে পেরেছি আমরা। তার বেশি কিছু বুঝতেই পারিনি। ফলে কেন রোগীর সংখ্যা নাটকীয় ভাবে কমে গেল, সেটা বলা মুশকিল।’’ এই রহস্যের কূলকিনারা কেউ পাচ্ছেন না। তবে অনেকের মতে, এতে কোনও রহস্যই নেই। কারও কারও বক্তব্য, সংক্রমণ সামলাতে ভারতে সরকারি পদক্ষেপগুলি পথপ্রদর্শক হয়ে উঠছে। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এই ভাবে নেমে যাওয়াটা সংক্রমণ রোখার ক্ষেত্রে নেওয়া প্রশাসনিক ব্যবস্থারই সুফল।

নানা পত্রিকায় নানা কারণ তুলে ধরা হচ্ছে। কেউ বলছেন, বাইরে বেরনোর সময় মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে যে সচেতনতা ও নিয়মানুবর্তিতার পরিচয় দিয়েছেন ভারতীয়রা, তারই পরিণতিতে নাটকীয় ভাবে কমে গিয়েছে রোগীর সংখ্যা। তার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনেরও ভূমিকা রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, ‘‘লকডাউনের সময় যাতে সকলে নিয়মবিধি মেনে চলেন তার উপর সবকটি পুরসভাকে কড়া নজর রাখতে বলা হয়েছিল। প্রতিটি এলাকায় পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছিল। নিয়মবিধি ভাঙলে পুলিশ ও পুরসভাগুলিকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। সর্বাধিক ৫০০ টাকা জরিমানা নেওয়া হয়েছে এমন অনেক ঘটনার কথা জানি। তবে খুব সম্ভবত জেল হয়নি কারও।’’

কেউ কেউ মনে করেন, নিয়মবিধি মেনে চলার জন্য যে সব কড়াকড়ি করা হয়েছিল, তাতে কাজ হয়েছে। জরিমানা দিতে হবে বা জেলে যেতে হবে, এই ভয়ে মানুষ বাড়ির বাইরে বেরনোর সময় নিয়মবিধিগুলি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাই যেখানে শিক্ষা ও সচেতনতা তুলনায় কম, সেই বস্তিপ্রধান এলাকাগুলিতেও করোনা রোগীর সংখ্যা গত চার মাসে কমে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।দুর্গাপুজো থেকে উৎসবের মাসগুলিতেও বাঙালি সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে উৎসবের পরে পরেই পশ্চিমবঙ্গে যে আরও অনেক বড় চেহারার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হয়েছিল, এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু তো ঘটেইনি, বরং নাটকীয় ভাবে কমে এসেছে রোগীর সংখ্যা।

তবে এগুলো স্বীকার করতে অনেকেই রাজি নন। ‘‘কোভিড রোগীর সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে ঝপ করে নেমে গিয়েছে এমন কোনও গ্রাফ এখনও পর্যন্ত হাতে নেই আমাদের’’, বলছেন ‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর সভাপতি এবং কল্যাণীর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স (এনআইবিএমজি)’-র প্রাক্তন অধিকর্তা জিনতত্ত্ববিদ পার্থপ্রতিম মজুমদার। পাশাপাশিই অবশ্য তিনি বলছেন, ‘‘তবে কোভিড পরীক্ষাও আগের চেয়ে কম হচ্ছে।’’

কিন্তু প্রশাসনিক পদক্ষেপ বা মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এটা হচ্ছে, তা মানতে নারাজ পার্থপ্রতিম। তাঁর মনে হচ্ছে, এত দিনে এই রাজ্যের জনসংখ্যার মধ্যে এই সংক্রমণ উপসর্গহীন বা অ্যাসিম্পটোম্যাটিক অবস্থায় এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, মানুষ না জেনে না বুঝতে পেরেই সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের শরীরও ভাইরাসটির সঙ্গে যুঝতে যুঝতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলেছে। সেটা গোটা জনসংখ্যার মধ্যেই হয়েছে। ফলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার জন্য আর নতুন আশ্রয়দাতা পাচ্ছে না। হয়তো তাই রাজ্যে গত ১৫-২০ দিনে করোনা রোগীর সংখ্যা কমে গিয়েছে।

পার্থপ্রতিমের ধারণা, ‘‘এটা অবশ্য সম্ভাব্য কারণ। কেন কমছে, সেটা বোঝার জন্য সবচেয়ে জরুরি রাজ্যের মোট জনসংখ্যার অ্যান্টিবডি টেস্ট করানো। সে আরপিসিআর-ই হোক বা র্যারপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট। এটা হচ্ছে না। এটা করলেই কিছুটা বোঝা সম্ভব হবে যে, সংখ্যাটা কেন কমছে।’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘বস্তি থেকে কি কখনও কোনও সুসমণ্বিত পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়েছে?’’ একই কথা তিনি বলছেন সংখ্যালঘু মুসলিমদের কম আক্রান্ত হওয়া প্রসঙ্গেও। পার্থের বক্তব্য, ‘‘সেখানেও সে ভাবে পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়নি। বলা হচ্ছে, মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের মানুষদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ওই সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেও সে ভাবে পরিসংখ্যান নেওয়া হয়নি। যদি তা সত্যিই হয়, তা হলে বলতে হবে এর কারণ মেদবাহুল্য, উচ্চ রক্তচাপ বা রক্তে অতিরিক্ত শর্করার মতো বিবিধ কো-মর্বিডিটি।’’

অনেকটা একই মত ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)’-এর প্রাক্তন অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল এবং ‘নাইসেড’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, ‘‘এই রাজ্যের গোটা জনসংখ্যার সার্বিক ভাবে অ্যান্টিবডি টেস্ট করানো সম্ভব না হলে কিছুতেই বোঝা যাবে না করোনা রোগীর সংখ্যা সত্যি সত্যিই কমে গিয়েছে নাকি এটা আমাদের বোঝার ভুল। এই ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য যে পরিমাণে কোভিড পরীক্ষার প্রয়োজন, তা হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গে।’’তবে সুজিত স্বীকার করেন, প্রশাসনের ভূমিকা এবং মানুষের সচেতনতা এর একটি কারণ হতে পারে।

‘‘জীববিজ্ঞানের গবেষণার চেয়ে তথ্যের কচকচিটাই বেশি হচ্ছে’’, মনে করেন বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্স (এনসিবিএস)’-এর অধ্যাপক জীববিজ্ঞানী সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, বিভিন্ন সময়ে এক এক রকম তথ্য আমাদের হাতে আসছে আর তার ভিত্তিতেই গবেষণা হচ্ছে। গবেষণাপত্র লেখা হচ্ছে। পরে আবার কিছু তথ্য আসবে যার ফলে আগের গবেষণাপত্রের সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাবগুলিকে বদলাতে হতে পারে।

সুমন্ত্রের কথায়, ‘‘কোভিড রোগীর সংখ্যা হঠাৎ কমে যাওয়ার সঠিক কারণ জীববিজ্ঞান এখনও জানতে পারেনি। হতে পারে প্রশাসনিক পদক্ষেপ। হতে পারে মানুষের সচেতনতা। এ-ও হতে পারে যে, আমাদের দেশের মানুষ শরীর অনেক দ্রুত স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু সেটা কেন, তার কারণ আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের খুঁজে বার করতে হবে। এ-ও হতে পারে যে, আমাদের দেশে ভাইরাসটির নতুন কোনও মিউটেশন হয়েছে। ফলে সেটি ইউরোপের মতো আরও আক্রমণাত্মক না হয়ে উঠে বরং কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে। সেটা কেন, তারও কারণ খুঁজে বার করতে হবে আমাদের দেশের জীববিজ্ঞানীদের।’’

কোভিড রোগীর সংখ্যা সরকারি তথ্যাদিতে কতটা সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকেই সংক্রমিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা বুঝতেও পারেননি। তাই তাঁরা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার কথা ডাক্তারদের বা হাসপাতালগুলির কাছে জানাননি। কোভিড পরীক্ষাও করাতে যাননি। ফলে, প্রশাসনিক পদক্ষেপ বা মানুষের সচেনতনতার জন্যই ডিসেম্বর থেকে কোভিড রোগীর সংখ্যা কমে গিয়েছে এই বক্তব্য মেনে নেওয়া মুশকিল।’’ একই কথা বলছেন একটি বেসরকারি হাসপাতালের পালমোনোলজিস্ট সুমিত সেনগুপ্তও। তাঁর কথায়, ‘‘আমার চারপাশের যা অভিজ্ঞতা, তাতে সরকারি পরিসংখ্যান বা বিভিন্ন বিজ্ঞান-পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলির বক্তব্য মেনে নিতে পারছি না। সরকারি পরিসংখ্যানগুলি দেওয়া হয় নানা ধরনের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে। আর সেই সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই গবেষণা করেন বিভিন্ন দেশের গবেষকরা। যাঁদের বেশির ভাগই বিদেশি। তাঁরা এ দেশের অনেক বিষয় সম্পর্কেই অবহিত থাকেন না বা অবহিত থাকার রসদ পান না সময়মতো। পরে যে বাংলা-সহ গোটা ভারতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ উঠবে না তা-ই বা কে বলতে পারেন?

ফাইল ছবি।

সুমিত অবশ্য এও জানাচ্ছেন তাঁর হাসপাতালে গত সেপ্টেম্বরে গড়ে ৭৫ জন রোগী থাকতেন। এখন সেই সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। থাকছেন মাত্র ৮ জন। তবে তার পরেও তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই সব দেখিয়ে যাঁরা কোভিড রোগীর সংখ্যা কমে গিয়েছে বলে দাবি করছেন তাঁরা কতটা সঠিক, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। অল দিজ নাম্বারস আর ননসেন্স।’’

বিজ্ঞান পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত গবেষণাগুলির মধ্যে একটির দাবি, ভারতে কোভিড রোগীর সংখ্যা গত ৪ মাসে কমার জন্য বড় ভূমিকা রয়েছে ভারতের জলবায়ুর। তাঁদের বক্তব্য, উষ্ণ এলাকা ও সেখানকার বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ তুলনায় অনেক বেশি বলে সেখানে এই ভাইরাস বেশি ক্ষণ বাতাস থাকতে পারে না। বাতাসে বেশি দূর এগিয়ে যেতেও পারে না। মাটিতে নেমে আসে। ফলে তাদের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।

মাস্ক পরতে কেউ ভুলছেন না। -ফাইল ছবি।

একই কথা খাটে কলকাতার ক্ষেত্রেও। কলকাতাও মোটের উপর উষ্ণ এলাকা। শীতের কয়েকটা দিন বাদ দিলে। কলকাতার বাতাসেও আর্দ্রতার পরিমাণ যথেষ্ট। তাই কলকাতায় করোনা রোগীর সংখ্যা নাটকীয় ভাবে কমে যাওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে, বিশেষজ্ঞদের কারও কারও এমনটাই ধারণা। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অরিন্দম বিশ্বাস বলছেন, ‘‘বহু গবেষণাই আগে ও পরে দেখিয়েছে উষ্ণ ও আর্দ্র এলাকাগুলিতে এই ভাইরাসের কার্যক্ষমতা কমে যায়। তাই কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে রোগী কমার এটাও একটা কারণ হতে পারে।’’ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের উষ্ণ জলবায়ু যদি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমার কারণ হয়ে থাকে, তা হলে এখন উত্তর ভারতের কনকনে ঠান্ডাতেও কেন তা কমছে— এই প্রশ্ন জরুরি।

সেই সূত্রেই সুবর্ণর বক্তব্য, ‘‘তা হলে তো অতিমারির পিক পিরিয়ডে দার্জিলিং, সিকিমের শহুরে এলাকাগুলিতে কলকাতা বা রাজ্যের অন্য জেলাগুলির তুলনায় সংক্রমণ বেশি ছড়াত। ওই এলাকাগুলিতে তো বেশি ঠান্ডা। এলাকাগুলির বাতাসও অনেক বেশি শুষ্ক। আর্দ্রতাও অনেক কম। তা হলে কেন পিক পিরিয়ডে ওই এলাকাগুলির চেয়ে কলকাতায় করোনা রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হয়েছিল?’

লকডাউনের সেই দিনগুলতে...- ফাইল ছবি।

অনেকের দাবি, ভারতের মোট জনসংখ্যায় প্রবীণদের চেয়ে তরুণ প্রজন্মের আধিক্যই করোনা রোগীদের সংখ্যা দ্রুত কমার অন্যতম কারণ হতে পারে। এই বক্তব্য মানতে নারাজ সুবর্ণ গোস্বামী ও সুমিত সেনগুপ্ত। তাঁদের কথায়, ‘‘বয়সের সঙ্গে করোনার মৃত্যুর ঘটনাটি বেশি সম্পর্কিত। কারণ, প্রবীণদের নানা ধরনের কো-মর্বিডিটি থাকে। যেটা তরুণ প্রজন্মের থাকে না। তাই আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিতে প্রবীণদের মৃত্যু বেশি হয়েছে। কিন্তু ভারতে তরুণ এবং ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সিরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। সংক্রমণও ছড়িয়েছেন।’’ তবে অতিমারির পিক পিরিয়়ডে পশ্চিমবঙ্গে জনস্বাস্থ্য নজরদারির (পাবলিক হেল্থ ইনটেলিজেন্স) কাজটা খুব ভাল ভাবে হয়েছে বলে মনে করেন সুবর্ণ। এ ব্যাপারে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা যে ভাবে জেলায় জেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তা একটি মনে রাখার মতো ঘটনা বলে তাঁর ধারণা।

সুবর্ণ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ব্রাজিলের একটি শহরের। মানাউস। সেখানেও কোভিড রোগীর সংখ্যা হঠাৎ কমে গিয়েছিল। পরে সেখানে আবার দ্বিতীয় ঢেউ আরও বড় আকার নিয়েছে। ‘‘এই ঘটনা যে বাংলায়, গোটা ভারতেও ঘটবে না, তা-ই বা কে বলতে পারেন?’’, বলছেন সুবর্ণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement