ধর্নায় রাহুল গাঁধী। ছবি: প্রেম সিংহ।
তাঁর নিজের মুখে লাগাম নেই। তাঁর নেত্রীর দশাও তথৈবচ। তাই বলে অন্যের কুকথার প্রতিবাদ থেকে কি পিছিয়ে থাকতে পারেন তিনি! সুতরাং শুক্রবার সংসদে গাঁধীমূর্তির তলায় কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির অশালীন মন্তব্যের প্রতিবাদে তিনি হাজির।
তাপস পাল দলের ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যিনি ইদানীং বেশ নাম কিনেছেন।
নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে চাপে রাখতে সাধ্বী-প্রসঙ্গকে হাতিয়ার করেছে কংগ্রেস। বিজেপির দাপটে কোণঠাসা আঞ্চলিক দলগুলিও তাদের সঙ্গী। বিজেপির উত্থান সবচেয়ে বেশি মালুম দিচ্ছে যাদের, সেই তৃণমূলের সাংসদরা আজ সকাল থেকেই হাজির ছিলেন সংসদের ধর্নায়। মুখে কালো কাপড় বেঁধে, রাহুল গাঁধীকে কার্যত ঘিরে থেকে। হাতে পোস্টার: ‘সাধ্বী নিরঞ্জন সংসদ ছোড়ো।’
সেই দৃশ্য দেখে বিস্মিত বিজেপি সাংসদদের প্রশ্ন, সাধ্বী নিরঞ্জনকে যদি ইস্তফা দিতে হয়, তা হলে তাপস পাল ছাড় পাবেন কেন? কিংবা তাঁর নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? তিনিও তো ‘শালা’ থেকে শুরু করে ‘বাঁশ’-‘বাম্বু’ কুকথায় পিছিয়ে থাকছেন না। তা ছাড়া, সাধ্বী তো সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। তাঁকে তিরস্কার করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। সাধ্বীর মন্তব্যের জন্য সংসদে দুঃখপ্রকাশ করেছেন তিনি। আজই লোকসভায় মোদী বলেছেন, “সাধ্বীর মন্তব্য আমিও সমর্থন করি না। মন্ত্রী সংসদে ক্ষমাও চেয়েছেন। উনি গ্রাম থেকে এসেছেন। কেউ যখন ক্ষমা চায় তখন উদারতা দেখানো উচিত।” তাপস চলতি অধিবেশনে কয়েক দিন সংসদে এলেও কুমন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাননি। মমতাও তাঁকে তিরস্কার করেননি তেমন ভাবে।
নিজেকে ‘চন্দননগরের মাল’ বলে দাবি করা তাপস অবশ্য আজ বলেন, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তো আদালতের বিচারাধীন। ফলে, এই বিষয় নিয়ে এখন সংসদে আমি কিছু বলতে পারি না। তবে আমি আগেই দলের কাছে, আমাদের দলনেত্রীর কাছে, মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছি।” তাঁর মতো ‘ভদ্র ও রুচিশীল পরিবারের সন্তানকে’ কতটা উত্ত্যক্ত করা হলে সে ওই ধরনের মন্তব্য করে ফেলে তা একটু বিবেচনা করা উচিত বলেছেন তাপস। কিন্তু তাঁর ক্ষমাপ্রার্থনা যদি গ্রাহ্য হয়, তা হলে সাধ্বীর ক্ষেত্রে হবে না কেন? তাপসের জবাব, “মন্ত্রী কেন কুকথা বলবেন? কুমন্তব্যের বিরুদ্ধেই আমাদের ধর্না। দলের নির্দেশেই আমি কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছি।”
বিজেপি অবশ্য কংগ্রেস-তৃণমূল যুগলবন্দিকে কটাক্ষ করার সুযোগ বিন্দুমাত্র হাতছাড়া করেনি। ‘মাসতুতো ভাই’ বলে টিপ্পনি কেটে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের খোঁচা, “পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ঠেলায় ভরকেন্দ্র নড়ে গিয়েছে তৃণমূলের। দিল্লিতে একই অবস্থা কংগ্রেসের। তাই সাধ্বী নিরঞ্জনের কথা রাহুলের কানে বাজলেও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুকথা কানে ঢুকছে না। আসলে তৃণমূলের বাম্বুটা (খুঁটি অর্থে) কংগ্রেসের ভীষণ দরকার।”
পরিস্থিতি যে মোটেই স্বস্তিকর নয়, সেটা বিলক্ষণ বুঝছেন কংগ্রেস নেতারাও। তাই মমতার বাম্বু-মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদের হেঁয়ালিভরা জবাব, “উত্তর-পূর্বে ও পূর্বে বাঁশ একটি অর্থকরী গাছ। সেখানকার অর্থনীতি এর ওপর নির্ভরশীল। এক বার বাঁশ গাছে মড়ক লাগায় আর্থিক সঙ্কট হয়েছিল। বাঁশ ব্যাপারটাও খারাপ নয় তেমন। হলুদ রঙের বাঁশ দেখতে তো বেশ লাগে আমার...!” বেছে বেছে এক জন মুখ্যমন্ত্রীর কথার কেন বিচার হবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
আর রাজ্যসভায় কংগ্রেসের উপনেতা আনন্দ শর্মা তো প্রশ্নটা শুনে রেগেই গেলেন। অপ্রিয় প্রসঙ্গ এড়াতে ঠিক যেমনটা রেগে যেতেন জ্যোতি বসু। বললেন, “কথা হচ্ছে সাধ্বীর। অন্য কারও প্রসঙ্গ তুলে দয়া করে বিষয়টা লঘু করবেন না।”
প্রকাশ্যে মমতার প্রসঙ্গ এড়াতে চাইলেও ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা দলের রাজনৈতিক দায়, তার জেরে তৈরি হওয়া নয়া রসায়নের কথাই সবিস্তার বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, সংসদে তৃণমূলের সঙ্গে এই সমন্বয় সনিয়া গাঁধীর অনুমতিতেই হচ্ছে। কারণটা পরিষ্কার। মোদী বা বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে মমতা যে ভাষায় গালমন্দ করতে পারেন, কংগ্রেসের কোনও নেতা তা পারবেন না। অথচ তাঁদের মতে, এখন সেটাই জরুরি।
সেই কারণেই গত ক’দিন ধরে সংসদের আনাচে কানাচে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মেলামেশা সকলের নজর কাড়ছিল। এমনকী, গত পরশু দুই সভার মাঝে লবিতে দাঁড়িয়ে তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথাও বলতে দেখা যায় সনিয়াকে। আজ রাজ্যসভায় সাধ্বীর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব এনেছে ৯টি দল। তার এক নম্বরে সই করেছে কংগ্রেস। তিন নম্বরে তৃণমূল।
দায়ে পড়ে তৃণমূলের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে হলেও অস্বস্তি অবশ্য চাপা থাকছে না কংগ্রেস শিবিরে। অস্বস্তি বিশেষ করে রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের। যেমন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ধর্নার সময় দাঁড়ালেন তৃণমূল নেতাদের থেকে অনেক দূরে। এবং বললেন, “একটা কথা শুনে রাখুন। সাধ্বীর মন্তব্য আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুকথার মধ্যে কোনও ফারাক নেই। এ জন্য এক বার নয়, একশো বার মমতার সমালোচনা করব। নিন্দা করব। তার জন্য এআইসিসি যদি তাড়িয়েও দেয়, কোনও খেদ থাকবে না।”
কংগ্রেসের এই বেহাল দশা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে বিজেপি। কংগ্রেসের ‘শুভবুদ্ধি’ ফেরাতে আজ গাঁধীমূর্তির সামনে পাল্টা ধর্না দিলেন তাদের রাজ্যসভার সাংসদরা। গান ধরলেন, ‘‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম!”