ফাইল চিত্র।
বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের ‘আইকন’ দামোদর বিনায়ক সাভারকর সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী তৈরি করতে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসুকে হারানোর ডাক দিয়েছিলেন। তা হলে সঙ্ঘ পরিবার বা নরেন্দ্র মোদীর তাঁর উপরে কোন অধিকার রয়েছে বলে আজ প্রশ্ন তুলল কংগ্রেস।
শুক্রবার ইন্ডিয়া গেট থেকে অমর জওয়ান জ্যোতি সরানো নিয়ে বিরোধিতার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী হঠাৎ ইন্ডিয়া গেটে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি বসানোর ঘোষণা করেন। তাতে গোড়ায় কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। কারণ অমর জওয়ান জ্যোতি সরানো নিয়ে আপত্তি তুললেও সুভাষের মূর্তি বসানো নিয়ে আপত্তি করা সম্ভব ছিল না। উল্টে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহই গান্ধী পরিবার তথা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন।
আজ পাল্টা আক্রমণে গিয়ে কংগ্রেস প্রশ্ন তুলেছে, সংসদ ভবন় চত্বরে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কাছেই সেন্ট্রাল হলের সামনে সুভাষচন্দ্র বসুর বিরাট মূর্তি রয়েছে। গত সাত বছরে প্রধানমন্ত্রী মোদী সেখানে কত বার শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছেন? কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলেন, “আসলে নতুন সংসদ ভবন তৈরি করে, সেন্ট্রাল ভিস্টা নতুন করে সাজিয়ে মোদী নিজের নাম লিখে যেতে চান। ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব পেতে চাইছেন। সেই কারণেই তিনি সব কিছু নতুন করে ভেঙে তৈরি করতে চাইছেন। অমর জওয়ান জ্যোতি সরিয়ে ফেলছেন।”
মোদী সরকারের যুক্তি ছিল, ইন্ডিয়া গেট ঔপনিবেশিক ইতিহাসের প্রতীক। ব্রিটিশ সরকারের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত ভারতীয় জওয়ানদের জন্য তা তৈরি হয়েছিল। সেখানে একাত্তরের যুদ্ধে নিহত জওয়ানদের স্মৃতিতে অমর জওয়ান জ্যোতি থাকতে পারে না। স্বাধীনতার পরে স্বাধীন ভারতের হয়ে যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের জন্য মোদী সরকারের তৈরি ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালেই অমর জওয়ান জ্যোতি থাকা উচিত। বিরোধীদের প্রশ্ন, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের প্রতীক ইন্ডিয়া গেটে অমর জওয়ান জ্যোতি যদি রাখা না যায়,
তা হলে সেখানে সুভাষ বসুর মূর্তি কী ভাবে থাকতে পারে?
বিরোধীদের যুক্তি, অমর জওয়ান জ্যোতি সরানোর পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে গিয়ে মোদী সরকার এখন ইন্ডিয়া গেটকে ঔপনিবেশিক ইতিহাসের প্রতীক বলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি-র হয়ে যুদ্ধে গিয়ে নিহত ভারতীয় সেনাদের ইতিহাসকে খাটো করতে চাইছে। ভারতীয় সেনার প্রথম ফিল্ড মার্শাল জেনারেল কে এম কারিয়াপ্পা, ১০৯১-এর যুদ্ধের নায়ক ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ— দু’জনেই প্রথমে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তা বলে কি তাঁদের ঐতিহ্যও লঘু করা হবে? এই একই প্রশ্ন আজ তুলে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন বহু অবসরপ্রাপ্ত জওয়ান এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
রবিবার সন্ধ্যায় সুভাষ বসুর জন্মবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্ডিয়া গেটের পিছনের ছত্রিতে লেজারে সুভাষ বসুর ত্রিমাত্রিক ছবি বা হলোগ্রাম মূর্তির উদ্বোধন করবেন। অনুষ্ঠানে সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান সম্পর্কে বক্তৃতাও করবেন প্রধানমন্ত্রী। আজ বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “সুভাষচন্দ্র বসু যদি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতেন, তা হলে আজকে ভারতে এই দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, বেকারত্ব, দেশের ভিতরে থেকে দেশবিরোধী কাজ— সব বন্ধ হয়ে যেত।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘মোদীজি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লিতে ইন্ডিয়া গেটে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা বাঙালি হিসাবে গর্বিত। নেতাজিকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে মর্যাদা দেওয়ায় মোদীজির জন্য সমান ভাবে গর্ব অনুভব করি।”
লোকসভায় কংগ্রেসের সচেতক মণিকম টেগোরের প্রশ্ন, সংসদে সুভাষ চন্দ্র বসুর মূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী কত বার শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছেন? সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের মোকাবিলায় ব্রিটিশদের বাহিনী তৈরি করতে সাভারকর সাহায্য করেছিলেন। ১৯৪০-এ সাভারকর হিন্দু যুবকদের দলে দলে ব্রিটিশ সেনায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। নিয়োগ শিবির আয়োজন করেন। সুভাষ বসুর পরাজয়ের ডাক দেন। সঙ্ঘ পরিবার ও মোদীর কী অধিকার রয়েছে সুভাষ বসুর উপরে? বিরোধীরা আজ মনে করিয়ে দিয়েছেন, সুভাষ বসু বরাবরই হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে প্রবল ভাবে সরব ছিলেন। হিন্দুত্ববাদী নেতাদেরও প্রকাশ্যেই বিরোধিতা করেছিলেন। আজ হিন্দুত্ববাদীরা তাঁকে নিয়ে যা করছে, তা আসলে সুভাষ বসুরই অপমান।
কংগ্রেস আজ অভিযোগ তুলেছে, মুখে সুভাষ বসুর জয়গান করলেও মোদী সরকার আসলে তাঁর মতাদর্শের বিরুদ্ধেই চলছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বারবার মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। দু’দিন আগেও তিনি বলেছেন, কর্তব্যে অবহেলা করে শুধু অধিকারের দিকে নজর দেওয়ায় দেশ দুর্বল হয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী আজ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘অধিকার না থাকলে বিশ্বের সবথেকে বড় গণতন্ত্রের অর্থ কী? মোদী সরকার জনগণের অধিকার শেষ করার চেষ্টা করছে। সংবিধানের মৌলিক অধিকার-সহ খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, তথ্যের অধিকার, রোজগারের অধিকার— এ সব নিয়ে মোদীর কী আপত্তি? কেন আপত্তি?’’ তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ জহর সরকার বলেন, ‘‘মোদী যদি প্রবল ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নেতাজিকে ‘হাইজ্যাক’ করতে চান, তা হলে আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য স্থির করা তাঁর তিনটি আদর্শকে গ্রহণ করুন। ইতমদ (বিশ্বাস), ইত্তেফাক (ঐক্য) ও কুরবানি (বলিদান)।’’
যদিও সুভাষ-কন্যা অনিতা বসু পাফের মতে, সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে ‘বিস্মৃত নায়ক’ করে তুলেছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ হয়তো নেতাজির প্রতি ঈর্ষাকাতর ছিলেন। সেই
কারণেই তাঁকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নিচু তলার নেতারা তাঁদের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বকে তুষ্ট করার জন্য এমন করতেন।’’