যা করছেন, তার ছাপ থাকছে ডিজিটাল দুনিয়ায়

আমজনতার রোজকার জীবনের মামুলি তথ্যই এখন ব্যবসায় মস্ত হাতিয়ার। ইন্টারনেটের দৌলতে আপনি যা করছেন, তার পায়ের ছাপ থেকে যাচ্ছে ডিজিটাল দুনিয়ায়। প্রতি সেকেন্ডে আপনা থেকেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে ‘ডেটা’ বা তথ্যের বিপুল ভাণ্ডার।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৭ ০৩:০৮
Share:

গুগল ম্যাপে খোঁজ করলেন, কলকাতা থেকে মন্দারমণি যেতে কতক্ষণ লাগে। তার পরেই ফেসবুক খুলে দেখলেন, মন্দারমণির নানা হোটেলের বিজ্ঞাপন আসতে শুরু করেছে!

Advertisement

বন্ধুর কাছে হোয়াটসঅ্যাপে জানতে চাইলেন, কোন স্মার্টফোনটা ভাল চলছে। এ বারেরও সেই একই কাণ্ড! ফেসবুকের দেওয়ালে নানা রকম মোবাইলের বিজ্ঞাপন!

সকালে অফিসে যাওয়ার পথে ফোন। আপনি গাড়ির ঋণ ঠিকমতো শোধ করছেন। তাই ব্যাঙ্ক আপনাকে নগদ ঋণ দিতে চায়।

Advertisement

আমজনতার রোজকার জীবনের মামুলি তথ্যই এখন ব্যবসায় মস্ত হাতিয়ার। ইন্টারনেটের দৌলতে আপনি যা করছেন, তার পায়ের ছাপ থেকে যাচ্ছে ডিজিটাল দুনিয়ায়। প্রতি সেকেন্ডে আপনা থেকেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে ‘ডেটা’ বা তথ্যের বিপুল ভাণ্ডার। মানুষের পছন্দ-অপছন্দের সেই তথ্য কাজে লাগিয়েই ঠিক হচ্ছে ব্যবসার রণকৌশল। কোন পণ্য বাজারে ছাড়া হবে, বিজ্ঞাপনের রণকৌশলই বা কী হবে— সবই ঠিক করে দিচ্ছে এই ‘ডেটা’-ই।

মুকেশ অম্বানী থেকে নন্দন নিলেকানি— সকলেই তাই বলছেন, ‘‘ডেটা ইজ দ্য নিউ অয়েল’। তথ্যের দাম এখন তেলেরই মতো। ফারাক শুধু, তেলের জোগান সীমিত। তথ্যের জোগান অফুরান।

ব্যক্তিপরিসরের অধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গত কাল যে রায় দিয়েছে তাতেই এ বার দাবি উঠেছে, কর্পোরেট দুনিয়া ওই তথ্য ব্যবহার করলে তার দাম দিক। সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তিপরিসরের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই মানুষের সম্পর্কে তথ্যে তাঁদেরই অধিকার। কর্পোরেট জগত তা নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারে না। দাবি উঠছে, এ বিষয়ে নতুন নীতি তৈরি করুক সরকার।

সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যান্ড সোসাইটি-র পলিসি ডিরেক্টর প্রাণেশ প্রকাশের মত, ‘‘প্রথম হল, কেউ তার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করতে দেবে কি না, তার জন্য অনুমতি নিতে হবে।’’ সুপ্রিম কোর্টে ব্যক্তিপরিসরের অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন সাজন পূভাইয়া। তাঁর যুক্তি, যে সব সংস্থা এই সব তথ্যভাণ্ডার নিয়ে কাজ করছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন তৈরির সময় এসেছে। আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশেও গোপনীয়তা ও তথ্য-সুরক্ষার আইন রয়েছে। ভারতে এই রকম আইন করতে হলে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করতে হবে। নয়তো গুগল, ফেসবুকের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলি মুশকিলে পড়বে।

সব মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পরে বিশেষজ্ঞরা এই একটি বিষয়ে এক মত যে, সরকারই হোক বা শিল্পমহল, স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করার ক্ষেত্রে রণকৌশল পর্যালোচনা করার সময় চলে এসেছে। রাজনীতিকদের মধ্যেও অনেকে একই যুক্তি দিচ্ছেন। বিজু জনতা দলের তথাগত সৎপথী যেমন যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘বেসরকারি সংস্থাগুলি আমাদের তথ্য নিজেদের মুনাফার জন্য কাজে লাগাচ্ছে। যদি ব্যক্তিগত তথ্যের মূল্য তেলের মতোই হবে, তা হলে আমাদের তার দাম মেটানো হোক।’’

আধারের কাজ শুরুর সময়ে তার প্রধান ছিলেন নন্দন নিলেকানি। সম্প্রতি একাধিক বক্তৃতায় তিনি শুধু তথ্যকে তেলের সঙ্গে তুলনা করেননি। হাতে গোনা কিছু সংস্থা সেই তথ্যভাণ্ডার কুক্ষিগত করে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁরও যুক্তি, যাঁর তথ্য, সেই তথ্যে মালিকানা তাঁরই।

শীর্ষ আদালতে ব্যক্তিপরিসরের অধিকারের পক্ষে সওয়ালকারী অন্যতম আইনজীবী অপার গুপ্তার যুক্তি, ‘‘কর্পোরেট দুনিয়া তেলের সঙ্গে তথ্যের ফারাক করছে না। কিন্তু তথ্য তেলের মতো মাটির তলা থেকে আসে না। মানুষের অজান্তে তার উপরে নিরন্তর নজরদারি চালিয়েই তথ্য উৎপাদন হয়। ব্যক্তিগত আচার-আচরণের হিসেবনিকেশ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তিপরিসরের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে সে ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ তৈরি করেছে।’’ প্রশ্ন এখন, সেই রক্ষাকবচের সুরক্ষা কী ভাবে পাবেন দেশবাসী? নিজের তথ্যে নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে কোন পথে?

এখনও জবাব নেই তার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement