জনজাতি সংঘর্ষে অশান্ত আগরতলা

মুহূর্তে পাল্টে গেল শান্ত আগরতলা শহরের ছবিটা। আলাদা ‘তুইপ্রাল্যান্ড’-এর দাবিদার, উপজাতি সংগঠন আইপিএফটি-র মিছিল থেকে আগরতলায় ছড়াল চরম উত্তেজনা। এবং শেষ পর্যন্ত তা জনজাতি-সংঘর্ষের রূপ নিল। প্রথম দিকে পুলিশ নির্বাক দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল।

Advertisement

আশিস বসু

আগরতলা শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৬ ২২:০৮
Share:

মুহূর্তে পাল্টে গেল শান্ত আগরতলা শহরের ছবিটা। আলাদা ‘তুইপ্রাল্যান্ড’-এর দাবিদার, উপজাতি সংগঠন আইপিএফটি-র মিছিল থেকে আগরতলায় ছড়াল চরম উত্তেজনা। এবং শেষ পর্যন্ত তা জনজাতি-সংঘর্ষের রূপ নিল। প্রথম দিকে পুলিশ নির্বাক দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল। পরে পরিস্থিতি সামলাতে লাঠি, শূন্যে গুলি চালায় তারা। শহর জুড়ে জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা।

Advertisement

আজ, ২৩ অগস্ট ষষ্ঠ তফশিল দিবস। এই দিনেই ত্রিপুরার এডিসি গঠনের বিল লোকসভায় অনুমোদিত হয়। গত কয়েক বছর ধরে আইপিএফটি এই দিন শহরে মিছিল, সভা করে। আজ দুপুরে আইপিএফটির সমর্থকদের মিছিল শহর পরিক্রমা শুরু করে। সেখান থেকে তাদের আস্তাবল ময়দানের সভাস্থলে যাওয়ার কথা। সংগঠনের সভাপতি এন সি দেববর্মার নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। আপাত শান্তিপূর্ণ মিছিল হঠাৎই মারমুখী হয়ে ওঠে। ওরিয়েন্ট চৌমুহনি, কর্ণেল চৌমুহনি, মঠ চৌমুহনি, লক্ষ্মীনারায়ণ বাড়ি-সহ শহরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বহু বাইক, স্কুটার, গাড়ি, এমনকী সংবাদমাধ্যমের গাড়িও ভাঙচুর করতে করতে মিছিল এগোতে থাকে। মারমুখী আইপিএফটি সমর্থকরা লাঠি, লোহার রড দিয়ে দোকানপাট, শো-রুমের কাচ ভেঙে গুড়িয়ে দেয় পুলিশের সামনেই।

রাস্তার পাশে কিছু পথচলতি মানুষকেও আক্রমণ করে তারা। তাদের আক্রমণের হাত থেকে বাদ যাননি মহিলারাও। পুলিশের সামনেই এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে রাস্তায় ফেলে লাথি মারতেও দেখা যায়। শকুন্তলা রোডে এক রিকশচালককে লাঠিপেটা করে জখম করে চলে যায় এক যুবক। পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হলে, পুলিশের জবাব, ‘‘বাত মাৎ কী জিয়ে। আভি ইহাঁসে চলা যাইয়ে।’’ অস্ত্র ও লাঠিধারী রাজ্য পুলিশের এই ‘ভূমিকায়’ স্থানীয় জনতার মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জমতে শুরু করে।

Advertisement

ও দিকে, ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে চলে মিছিল। পুলিশও নীরব দর্শক হয়ে মিছিলের পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় আস্তবল ময়দানের দিকে। কিন্তু ইতিমধ্যে অশান্ত হয়ে ওঠে শহুরে বাসিন্দারাও। ওরিয়েন্ট চৌমুহনী ও সূর্য চৌমুহনীতে পুলিশের গাড়ি ধরে উত্তেজিত জনতা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। ওরিয়েন্ট চৌমুহনীতে পুলিশের জিপ ভেঙে দেওয়া হয়। তাতেও পুলিশ শান্ত ছিল। উত্তেজিত জনতা ওরিয়েন্ট চৌমুহনীতে চার উপজাতি যুবককে আটকে রাখে। পুলিশ তাদের উদ্ধার করে জিপে তুলে সরিয়ে নিয়ে যায়। এতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। উত্তেজিত স্থানীয় বাঙালি যুবকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে রওনা দেয় আস্তাবল ময়দানের দিকে। পুলিশ তাদের আটকায়।

ততক্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজ্য পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছন। রাজ্য পুলিশের ডিজি কে নাগরাজও হাজির হন। আক্রান্ত জনতার তরফে ডিজির কাছে জানতে চাওয়া হয়, পুলিশ কেন নীরবে আইপিএফটির কর্মী-সমর্থকদের অসভ্যতা, তাণ্ডবকে প্রশ্রয় দিল? কেন পুলিশ এ ভাবে উত্তেজনা ছড়াতে সাহায্য করল? উত্তেজনা যারা ছড়াচ্ছে, তাদেরকে কেন পুলিশ গ্রেফতার করছে না? ডিজি কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি অনুরোধ করেন, ‘‘অনুগ্রহ করে পরিস্থিতে শান্ত হতে দিন। তার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ বাঙালি-উপজাতি সম্প্রীতি নষ্ট করে দেওয়ার এই ইন্ধন যারা যোগাচ্ছে, তাদেরকে গ্রেফতারের দাবিও উঠেছে শহরের বিভিন্ন অংশের পাল্টা জমায়েত থেকে।

আস্তাবল ময়দানের জনসভাকে কেন্দ্র করে সংলগ্ন অঞ্চলেও গোলমাল ছড়ায়। ডিম সাগরের পাড়ে তিন উপজাতি যুবককে বেধম মারধর করে স্থানীয় জনতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করে। বেসরকারি সূত্রের খবর, উপজাতি মিছিল থেকে ছড়িয়ে যাওয়া অশান্তি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৩৯ জন জখম হয়েছেন। আহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। মুখ্যসচিব যশপাল সিংহ জানান, ‘‘শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কয়েক জন জখম হয়েছেন। তবে মৃত্যুর কোনও খবর নেই।’’ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারা শহর জুড়ে টিএসআর, অসম রাইফেলস, বিএসএফ জওয়ানরা টহল দিচ্ছে। শান্তি বজায় রাখার জন্য শহর জুড়ে লাগাতার প্রচার শুরু হয়েছে।

প্রত্যাশিত ভাবেই এই ঘটনাকে ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। সিপিএমের মুখপাত্র গৌতম দাশ আজকের উত্তেজনা ও অশান্তির পিছনে ‘পূর্ব পরিকল্পনা’ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘শহরের শান্তি বিঘ্নিত করার উদ্দেশে আইপিএফটির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তৃণমূল এবং বিজেপি। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।’’ সিপিএমের বক্তব্যে ক্ষিপ্ত তৃণমূল নেতৃত্ব তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সমস্ত ঘটনার দায় মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানিক সরকারের ইস্তফার দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, তৃণমূলকে লোক সমক্ষে হেয় করার জন্যই সিপিএম আজকের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস চেয়ারম্যান রতন চক্রবর্তী উপজাতি-বাঙালি সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সবাইকে অনুরোধ করেন। রতনবাবুর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘সূর্য চৌমুহনিতে আইপিএফটির সমর্থকদের উত্তেজিত করে শাসক দলেরই কিছু সমর্থক। তারা মিছিল ভেঙে রাস্তা পার হতে চেষ্টা করে। তাতেই উত্তেজনা ছড়ায়।’’ কংগ্রেসও আজকের ঘটনায় প্রশাসনকেই কাঠগড়ায় তুলেছে। বিজেপি সভাপতি বিপ্লব দেবের আঙুলও প্রশাসনের দিকে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘অশান্তির আগুন লাগাতে শাসক দলের ইন্ধন ছিল আজ।’’ তবে সব পক্ষই বাঙালি ও উপজাতি সম্প্রীতি রক্ষার আবেদন করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement