প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। —ফাইল চিত্র।
শুরু করেছিলেন আশা জাগিয়ে। শেষ করলেন অনেক প্রশ্ন রেখে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় প্রায় দু’বছরের ইনিংস শেষ করলেন। সাম্প্রতিক অতীতে এত দীর্ঘ সময় কেউ প্রধান বিচারপতিরআসনে থাকেননি।
রবিবার খাতায়-কলমে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের শেষ দিন। শুক্রবার ছিল তাঁর আদালতের এজলাসে বসার শেষ দিন। দুপুরে প্রধান বিচারপতির এজলাসে আইনজীবীরা যখন প্রথা মেনে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করছেন, তখন বাইরে সুপ্রিম কোর্টের চত্বরে এক প্রবীণ বাঙালি আইনজীবীকে প্রশ্ন করা গেল, প্রধান বিচারপতি হিসেবে চন্দ্রচূড়ের মেয়াদ কেমন কাটল?
উত্তর মিলল, “অবিকল আর জি করের মামলার মতো। সুপ্রিম কোর্ট যখন আর জি করের মামলা হাতে নিল, তখন সবাই আশা করেছিলেন, এ বার বিচার মিলবে। শেষবেলায় দেখা গেল, সুপ্রিম কোর্টের থেকে কেউই কিছু আর আশা করছেন না। আমরাও একই ভাবে প্রধান বিচারপতি হিসেবে চন্দ্রচূড়ের থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলাম। শেষে হতাশ হতে হল।”
প্রধান বিচারপতি হিসেবে শেষ পর্বে এসে নিজের বাড়ির গণেশ পুজোয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রাক্তন বিচারপতি ও আইনজীবীদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়কে। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির দেখা হওয়া মানেই তাঁরা মামলা নিয়ে কথা বলছেন, এমন নয়। তাতে লাভ হয়নি। রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিবাদে সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ ভাঙাকে অন্যায় বলে আখ্যা দিয়েও শুধুমাত্র হিন্দুদের বিশ্বাসের যুক্তি দিয়ে রামমন্দির তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল। সেই রায়ের লেখক হিসেবে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, তিনি ঈশ্বরের সামনে বসে সমাধানের প্রার্থনা করেছিলেন। তীব্র নিন্দা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টে কোন বিচারপতি কোন মামলা শুনবেন, তা ঠিক করার দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের সেই ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ তিনি এমন এক বিচারপতির কাছে সমস্ত জামিনের মামলা পাঠিয়েছেন, যেখানে বিনা বিচারে বন্দি অভিযুক্তদের জামিন খারিজ হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, ইতিহাস তাঁকে কী ভাবে মনে রাখবে? সমাজমাধ্যমে বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। শেষ দিনে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে রায়ে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত অভিযোগ তুলেছেন, রায় নিয়ে বিচারপতিদের মধ্যে ঠিকমতো আলোচনাই হয়নি। প্রধান বিচারপতির লেখা রায় অনেক দেরিতে তাঁর কাছে এসেছে।
যাবতীয় সমালোচনার জবাবেই আজ কর্মজীবনের শেষ দিনে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘‘আমি নিজের ব্যক্তিগত জীবন সকলের সামনে তুলে ধরেছি। তা করলে সমাজমাধ্যমের যুগে নিজেকেও সমালোচনার মুখে ফেলতে হয়। সব রকম সমালোচনা গ্রহণের জন্য আমার কাঁধ যথেষ্ট চওড়া।’’ নিজের সমালোচকদের কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘‘আমি বোধহয় সবথেকে সমালোচিত ব্যক্তি। কিন্তু আমার চিন্তা, সোমবার থেকে কী হবে? যাঁরা আমাকে ‘ট্রোল’ করছেন, তাঁদের তো আর কাজথাকবে না।’’
কেন সাড়া জাগিয়ে শুরু করেও প্রধান বিচারপতি হিসেবে আইনজীবীদের হতাশ করলেন চন্দ্রচূড়? আইনজীবীদের মতে, সরকারি স্তরে ও রাজনৈতিক স্তরে গত কয়েক বছরে বহু সাংবিধানিক প্রক্রিয়া লঙ্ঘন হয়েছে। প্রধান বিচারপতি হিসেবে চন্দ্রচূড়ের সামনে এই সব ক্ষেত্রে কড়া অবস্থান নেওয়ার সুযোগ ছিল। তিনি সব সুযোগ হাতছাড়া করেছেন।
উদাহরণ? মণিপুরের হিংসা। রাজ্যে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ-হিংসা চলছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিভাজনের নীতির অভিযোগ উঠলেও সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ কিছুই করেনি। কেন্দ্রীয় সরকার ও দিল্লির সরকারের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে বিবাদ চলেছে। সুপ্রিম কোর্ট তার কোনও চূড়ান্ত সমাধান দিতে পারেনি। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে সেবির ভূমিকা, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ার কেলেঙ্কারির অভিযোগ ধামাচাপাপড়ে গিয়েছে।
একই ভাবে পেগাসাস কাজে লাগিয়ে বিরোধী নেতা, বিচারপতি, সমাজকর্মী, আইনজীবীদের মোবাইলে আড়ি পাতার অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ভাঙিয়ে বিজেপির সরকার গঠন নিয়ে রায় দিতে দিতে নির্বাচন চলে এসেছে। মুখে প্রধান বিচারপতি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বললেও জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভার সুপারিশ ছাড়াই রাজ্য ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছেন। নির্বাচনী বন্ড বেআইনি বলে বাতিল করলেও নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে বা সুবিধা পাইয়ে দিয়ে শাসক দল বিজেপির চাঁদা আদায়ে তদন্তের নির্দেশ দেননি। সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সুপারিশ সত্ত্বেও মোদী সরকারের তরফে বিচারপতি নিয়োগে দেরি করা নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করেননিতিনি। অথচ এ বিষয়ে কড়া অবস্থান নেওয়া বিচারপতি সঞ্জয় কিষেণ কউলের হাত থেকে নিজের হাতে এই মামলা নিয়ে নিয়েছেন।
কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে দু’টি বিষয়ে মামলাকারী হিসেবে আমি খুবই হতাশ। আধার বিলকে অর্থ বিলের তকমা দিয়ে সংসদে পাশ করানোকে সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা বলার সাহস দেখালেও তিনি তা খতিয়ে দেখতে বেঞ্চ গঠন করেননি। তথ্যের অধিকার আইনে মোদী সরকারের বিপজ্জনক সংশোধনের বিরুদ্ধে মামলা চার বছর ধরে ঝুলে রয়েছে।’’
আজ শেষ দিনে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, আদালতে বসে সব অন্যায়ের সমাধান করা যায় না। কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকলে তার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রবীণ আইনজীবী দুশ্যন্ত দাভের মতে, ‘‘যথেষ্ট গুণ ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রধান বিচারপতি হিসেবে ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় হতাশ করেছেন।’’
আইনজীবীদের কৌতূহল, অবসরের পরে কি প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় কোনও পদ গ্রহণ করবেন? প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে যে পাঁচ বিচারপতি রামমন্দিরের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ইতিমধ্যেই অবসরপ্রাপ্ত চার জন কোনও না কোনওগুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। গগৈ রাজ্যসভায় মনোনীত হয়েছেন। চন্দ্রচূড় কী করবেন?
প্রবীণ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ লিখেছেন, ‘‘আমি সবসময়ই বলি, বিচারপতিদের বিচার হয় অবসরের পরে তাঁদের আচরণ দেখে। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ক্ষমতা থেকে অবসর নেবেন না।’’