চিনা বাহিনীর সদস্যদের এই কান্নার ছবিই অস্বস্তিতে ফেলেছে বেজিংকে। ছবি-ভিডিয়ো থেকে।
প্রচার-যুদ্ধে বরাবর গোটা পৃথিবীকে পিছনে ফেলে এসেছে চিন। এ বার তাতেই বড় ধাক্কা। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে বেজিঙের অস্বস্তি বেজায় বাড়াল একটি ভিডিয়ো। বাসে করে চিন-ভারত সীমান্তের দিকে আসার সময়ে কাঁদছেন লালফৌজের সদস্যরা— এই দৃশ্য দেখা গিয়েছে ভিডিয়োয়। কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু হওয়ার আগেই জোর হইচই পড়ে গিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। ভারত সীমান্তে যাওয়ার নামেই ‘আতঙ্কিত’ চিনা সেনারা, প্রমাণ করছে ওই ভিডিয়ো— এমন কথা লেখা হয়েছে তাইওয়ানের একাধিক সংবাদপত্রে। আর সে প্রতিবেদনের ধাক্কা এমনই সজোরে লেগেছে বেজিঙে যে, সরকারি সংবাদমাধ্যমকে মাঠে নামাতে বাধ্য হয়েছে চিন।
যে ভিডিয়োকে কেন্দ্র করে এই হইচই, সেটি ভুয়ো, এমন কথা কিন্তু চিন বলতে পারেনি। ভিডিয়োটির ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে।
রবিবার ভিডিয়োটি আন্তর্জাতিক মহলের সামনে আসে। তাতে দেখা যায় যে, একটি বাসে করে একদল চিনা সেনাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পূর্ব চিনের আনহুই প্রদেশ থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পশ্চিম চিনের দিকে অর্থাৎ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) দিকে। পিএলএ (চিনা ফৌজ) সদস্যরা সবাই মিলে একটি গান গাইছিলেন এবং প্রায় প্রত্যেকেই বিহ্বল হয়ে কাঁদছিলেন।
আরও পড়ুন: বিরোধীদের অনুপস্থিতির সুযোগে বিতর্ক ছাড়াই রাজ্যসভায় দু’দিনে ১৫টি বিল পাশ মোদী সরকারের
আনহুই প্রদেশের একটি গণমাধ্যম গত সপ্তাহে ভিডিয়োটি প্রথম প্রকাশ্যে আনে বলে জানা গিয়েছে। সেখান থেকে চিনা সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং চিনের নানা ডিজিটাল মাধ্যমে ভিডিয়োটি ছড়াতে থাকে। তার পরের কয়েক দিনে চিনের বাইরে ফেসবুক এবং টুইটারেও তা শেয়ার হতে শুরু করে। চিনের ঘোর শত্রু হিসেবে পরিচিত তাইওয়ানের সংবাদমাধ্যম প্রায় লুফে নেয় ভিডিয়োটি। ভারত-চিন উত্তেজনার প্রেক্ষিতে লাদাখের সীমান্তে মোতায়েন করার জন্য পাঠানো হচ্ছে এই চিনা সেনাদের এবং তাঁরা আতঙ্কে কাঁদছেন— লেখা হয় তাইওয়ানের একাধিক সংবাদপত্রে।
লাদাখে গত কয়েক মাসে ভারতীয় এবং চিনা বাহিনীর মধ্যে একাধিক সংঘর্ষ ঘটে গিয়েছে। গলওয়ানের রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতে বড় সংখ্যায় প্রাণহানি তো ঘটেইছে, প্যাংগং-এর উত্তর তটে যে এলাকায় কোনও পক্ষেরই স্থায়ী সেনাঘাঁটি ছিল না, সেই ফিঙ্গার-৪ এবং হট স্প্রিং এলাকায় ঢুকে শিবির তৈরি করেছে লাল ফৌজ। পাল্টা পদক্ষেপে প্যাংগং-এর দক্ষিণে প্রায় ৭০ কিলোমিটার বিস্তারে হেলমেট টপ, ব্ল্যাক টপ, রেজাং লা, রেচিন লা-র মতো কৌশলগত ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একাধিক অঞ্চল আচমকা কব্জা করে চিনকে বেকায়দায় ফেলেছে ভারত। সঙ্ঘাত কমানোর জন্য দু’পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন স্তরের বৈঠকও হচ্ছে। আবার তার পাশাপাশি এলএসি বরাবর দু’পক্ষই সৈন্য সমাবেশ এবং সামরিক প্রস্তুতিও বাড়িয়ে চলেছে। আর ভারত-চিন সীমান্তের এই তুমুল উত্তেজনার দিকে সারা ক্ষণ নজর রেখে বসে রয়েছে প্রায় গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।
চিনের সঙ্গে আমেরিকার সঙ্ঘাতও অনেক দিন ধরেই বাড়ছে। এ বারের ভারত-চিন সঙ্ঘাতের দিকে তাই আমেরিকাও নজর রাখছে। তারা খোলাখুলি ভারতের পক্ষে কথাও বলছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপান থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে তাইওয়ান-ও নজর রাখছে এই সঙ্ঘাতের দিকে। কারণ দক্ষিণ চিন সাগরে জলসীমার দখল নিয়ে এই সব দেশের সঙ্গে চিনের সঙ্ঘাত অনেক দিনের। কখনও আন্তর্জাতিক জলসীমার দখল নিয়ে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে চিন। কখনও দক্ষিণ চিন সাগরকে ঘিরে থাকা অন্যান্য দেশের জলসীমার অংশবিশেষে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। আর তাইওয়ানকে তো আলাদা দেশ হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি চিন। বেজিং মনে করে তাইওয়ান হল চিনের অংশ এবং প্রয়োজন হলে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তাইওয়ানের দখল নেওয়া হবে।
চিনের এই ‘দাদাগিরি’র প্রতিবাদ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলেও জানিয়েছে দক্ষিণ চিন সাগরকে ঘিরে থাকা দেশগুলি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। নিজেদের অধিকারের ক্ষেত্র ধরে রাখতে চিনের সঙ্গে সামরিক সঙ্ঘাতে যাওয়ার সাহস এই দেশগুলির কোনওটিই সাম্প্রতিক কালে দেখায়নি। বহু বছর পরে ভারতই প্রথম চিনা আগ্রাসনের জবাব সামরিক ভাবে দিতে শুরু করেছে। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নৈতিক সমর্থন জোগাতে শুরু করেছে ভারত। প্রয়োজনে সামরিক সমর্থনও যে দেওয়া হতে পারে, সে ইঙ্গিতও নানা যৌথ মহড়া এবং সামরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে দেওয়া শুরু হয়েছে। তাইওয়ানের সংবাদমাধ্যমে চিনা বাহিনীকে নিয়ে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনও সে দেশে তীব্র চিন বিরোধী জনমতের প্রতিফলন বলেই সমর বিশারদরা মনে করছেন।
পাকিস্তানের সরকার চিনের পরম মিত্র। কিন্তু যে ভিডিয়ো সামনে এসেছে, তাতে পাকিস্তানের একাংশও চিনকে কটাক্ষ করতে শুরু করেছে। জাইজ হামিদ নামে এক পাকিস্তানি কমেডিয়ান চিনা সৈনিকদের কান্নার ভিডিয়োটি শেয়ার করেছেন। তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে কিছুটা কটাক্ষের সুরই দেখা গিয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমরা পাকিস্তানিরা আপনাদের সমর্থন করছি চিন। সাহস রাখুন।’’ অর্থাৎ ঘুরিয়ে বলতে চেয়েছেন, চিন সাহস ধরে রাখতে পারছে না।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? এলএসি-তে যাওয়া কি চিনা বাহিনীর অনেকের কাছেই এখন আতঙ্কের কারণ? ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই দাবি, গলওয়ানের সংঘর্ষ আতঙ্ক তৈরি করেছে চিনা বাহিনীর অন্দরে। ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত কর্তা মেজর জেনারেল অরুণ রায়ের কথায়, ‘‘গলওয়ানের সংঘর্ষে চিনা বাহিনীর কত জনের মৃত্যু হয়েছে জানেন? আমাদের তো ২০ জন শহিদ হয়েছেন, ৪৩ জন জখম। আমরা সবাই জানি। কিন্তু চিন তো কোনও সংখ্যা জানায়নি।’’ চিনের তরফে প্রাণহানির সংখ্যা কত? মেজর জেনারেল রায়ের কথায়, ‘‘ওই সংঘর্ষে চিনা বাহিনীর অন্তত ১৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। উপগ্রহ চিত্রে ১০৬ জনের সমাধিও চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। আর জখমের সংখ্যা আরও কত, সেটা বলতে পারব না।’’
মেজর জেনারেল অরুণ রায় যে সংখ্যার কথা বলছেন, আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে চিনের তরফে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির সেই রকম হিসেবই দেওয়া হয়েছিল। মার্কিন এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী সংখ্যাটা অত বড় নয়। উপগ্রহ চিত্র এবং গলওয়ান সংঘর্ষের পরে এলএসি-তে চিনা বাহিনীর কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে হতাহতের হিসেব তুলে ধরেছিল তারা। তবে সেই হিসেবেও দাবি করা হয়েছিল যে, গলওয়ানের সংঘর্ষে ভারতের চেয়ে চিনের ক্ষতি বেশি হয়েছে।
ভারতীয় সেনাকর্তাদের কারও কারও দাবি, চিন যতই খবর চেপে দেওয়ার চেষ্টা করুক, সে দেশের বাহিনীতে গলওয়ানে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির কথা বেশ খানিকটা ছড়িয়েছে। ফলে ভারত-চিন সীমান্তে মোতায়েন হওয়ার প্রশ্নে অনেকের মনেই ভীতির সঞ্চার হচ্ছে। মেজর জেনারেল রায়ের কথায়, ‘‘লাদাখের মতো উঁচু এলাকায় যুদ্ধ করা অত সহজ বিষয় নয়। তার জন্য ‘মাউন্টেন ট্রেনড ফোর্স’ দরকার। অর্থাৎ পাহাড়ে যুদ্ধের জন্য বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত হতে হয়। ভারতের হাতে পৃথিবীর বৃহত্তম মাউন্টেন ট্রেনড আর্মি রয়েছে। চিনা বাহিনী পাহাড়ে অত দক্ষ নয়।’’ যে ভিডিয়ো ছড়িয়েছে, সেটা সত্যিই চিনা সেনার মধ্যে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কের প্রমাণ কি না, তা নিয়ে ওই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলছেন, ‘‘আমাদের বাহিনীতে কাউকে জোর করে ঢোকানো হয় না। কিন্তু চিনের বাহিনীতে কাজ করা বাধ্যতামূলক। তরুণদের একটা সময়ে বাধ্যতামূলক ভাবে বছর পাঁচেকের জন্য পিএলএ-তে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ বছর পরে তাঁরা ফিরে গিয়ে আবার কলেজের পড়া শেষ করেন। চিনে এই রকম ব্যবস্থা রয়েছে। এই ধরনের বাহিনী দিয়ে লাদাখের পাহাড়ে ভারতীয় বাহিনীর মোকাবিলা করা সহজ নয়।’’
আরও পড়ুন: গত তিন বছরে ভারত সীমান্তে দ্বিগুণ শক্তি বাড়িয়েছে চিন, বলছে রিপোর্ট
চিনের তরফ থেকে কিন্তু এই সব তত্ত্বের তীব্র বিরোধিতা করা হচ্ছে। যে ভিডিয়োকে তাইওয়ানের সংবাদমাধ্যম চিনা বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কের প্রমাণ বলে তুলে ধরছে, সেটা আসলে আবেগের বহিঃপ্রকাশের ভিডিয়ো, দাবি গ্লোবাল টাইমসের। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাইওয়ানের সংবাদমাধ্যম বিভ্রান্তি তৈরি করছে বলে বেজিঙের দাবি। পিএলএ সদস্যরা যখন তাঁদের পরিজনদের বিদায় জানাচ্ছিলেন, এটি সেই সময়ের ভিডিয়ো, তাই তাঁরা আবেগপ্রবণ ছিলেন— দাবি করেছে চিনা সংবাদপত্র। ভিডিয়োটিতে অবশ্য কাউকে বিদায় জানানোর দৃশ্য দেখা যায়নি। চলন্ত বাসে বসে গান গাইতে এবং কাঁদতেই দেখা গিয়েছে চিনা ফৌজকে।