India-China Conflict

বিদ্যুৎ সরবরাহেও ড্রাগনের ভাইরাস হানা? সন্দেহ বাড়াচ্ছে দিল্লির নীরবতা

কূটনীতিকদের মতে, ভারতকে চাপে রাখাই কৌশল চিনের। বোঝাতে চাইছে, প্রযুক্তিগত ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে ভারতকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে পারে তারা।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

ওয়াশিংটন শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২১ ১৪:৫৮
Share:

বিদ্যুতেও হানা চিনের! —ফাইল চিত্র।

শুধুমাত্র সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘর্ষ নয়, ভারতকে প্রতিহত করতে ভারতের মাটিতেও জাল বিস্তার করছে চিন। তার জন্য ভারতের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পেট্রো শোধনাগার এমনকি, পরমাণু শক্তিকেন্দ্রগুলিকেও নিশানা করছে তারা। প্রযুক্তি-ক্ষতিকারক ভাইরাস ছড়িয়ে সেগুলিকে কাবু করে ফেলছে তারা। এমনই উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে আমেরিকার সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা ‘রেকর্ডেড ফিউচার’-এর একটি রিপোর্টে। প্রসঙ্গত, লাদাখে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘর্ষ চলাকালীন ২০২০-র অক্টোবরে আচমকা অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল দেশের বাণিজ্যনগরী মুম্বই। তার পিছনে চিনা সরকারের মদতপুষ্ট হ্যাকারদেরই হাত ছিল বলে দাবি করা হয়েছে ওই রিপোর্টে।

Advertisement

করোনা অতিমারির জেরে গত বছর যখন ধুঁকছে গোটা দেশ, সেই সময় ১২ অক্টোবর আচমকাই বিদ্যুৎ বিভ্রাটে থমকে যায় আরবসাগরের তীরে মায়ানগরী। শহরের ২ কোটি বাসিন্দা তো বটেই, সেখানকার পরিবহণ ব্যবস্থা, শিল্প এবং শেয়ারবাজারেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। স্টেশনে স্টেশনে থমকে যায় ট্রেন। কোভিড রোগীদের ভেন্টিলেটর চালু রাখতে জরুরি ভিত্তিতে চালু করতে হয় জেনারেটর। কল-কারখানায় বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। তার জেরে বিপুল ধস নামে শেয়ারবাজারে। সেই সময় জানা গিয়েছিল, কালওয়াতে সেন্ট্রাল লাইনে গ্রিড বসে যাওয়াতেই বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কবলে পড়েছে মায়ানগরী। বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ শুরু করায় ২-৩ ঘণ্টার মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ঘণ্টায় প্রায় ২৫৮ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল বলে জানা যায়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামার পর তখন সাইবার হানার বিষয়টি উঠে এসেছিল। তবে পরবর্তীকালে তা নিয়ে আর কোনও তথ্যই সামনে আনা হয়নি।

যদিও ‘রেকর্ডেড ফিউচার’-এর দাবি, চিন সরকারের মদতে সে দেশের হ্যাকাররাই ওই বিভ্রাট ঘটিয়েছিল। তারা জানিয়েছে, ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ ঘিরে ২০২০-র ৫ মে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চিনাবাহিনীর সঙ্গে হাতাহাতি বেধে যায় ভারতীয় সেনার। তার পর দফায় দফায় সেখানে সঙ্ঘর্ষে জড়িয়েছে দু’পক্ষ। তাতে ২০ জন ভারতীয় জওয়ান প্রাণ হারান। প্রাণহানি ঘটে চিনা বাহিনিতেও। সেই সময়ই হাতে নয়, চিন সরকার ভারতকে কার্যত ‘ভাতে’ মারার সিদ্ধান্ত নেয়। তার জন্য দেশের শিল্পের প্রাণকেন্দ্র মুম্বইকেই বেছে নেয় তারা। ওই রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়েছে, সীমান্তে সঙ্ঘাত অব্যাহত থাকাকালীন দেশের প্রায় সর্বত্র বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রগুলির প্রযুক্তিতে ঝাঁকে ঝাঁকে চিনা ভাইরাস (ম্যালওয়্যার) ঢুকতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, ওই একই দিনে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন এবং একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রযুক্তিতেও ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ তাদের। তবে এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটিকেই সক্রিয় (অ্যাক্টিভেট) করা হয়েছিল। তাই একটি নির্দিষ্ট রাজ্যেই বিভ্রাট সীমাবদ্ধ ছিল। এক সঙ্গে সবক’টিকে সক্রিয় করে দিলে গোটা দেশ অন্ধকারে ডুবে যেত।

Advertisement

বিশ্ব জুড়ে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করে ‘রেকর্ডেড ফিউচার’-এর ‘ইনসিক্ট গ্রুপ’। তাদের দাবি, সরকারি মদতে ডিজিটাল মাধ্যমে হানা দিয়ে অন্য দেশের স্পর্শকাতর বিষয় সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য হাতিয়ে নেওয়া বা ক্ষতিকারক ভাইরাস ছড়িয়ে প্রযুক্তি বিকল করে দেওয়ার যাবতীয় কাজকর্ম সামলায় ‘রেডএকো’ নামের একটি সংস্থা। ‘অ্যাক্সিমেটিকঅ্যাসিম্পটোট’ নামের একটি ভাইরাসের মাধ্যমে প্রথমে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রযুক্তি হুবহু নকল করে নেয় তারা। তার পর সেটিকে বিকল করে দেয়। তার জেরেই গ্রিড বসে যায় এবং ব্যাহত হয় বিদ্যুৎ পরিষেবা। তবে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলাকালীন নিরাপত্তার আচ্ছাদন ভেদ করে ভারতের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রযুক্তির ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি ‘রেকর্ডেড ফিউচার’। তাই ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে চিনা হ্যাকাররা ঠিক কী ‘কোড’ ব্যবহার করেছিল, তা জানতে পারেনি তারা। তবে দিল্লিকে বিষয়টি জানিয়েছিল তারা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ভারত সরকার তা নিয়ে কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি এবং এ নিয়ে কোনও বিবৃতিও দেওয়া হয়নি।

যদিও আমেরিকার ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ সংবাদপত্রে এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশের পর মহারাষ্ট্র সরকার সাইবার হানার কথা মেনে নিয়েছে। সোমবার রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী নিতিন রাউত বলেন, ‘‘নিউইয়র্ক টাইমসের দাবি সত্য। আমাদের ৩ সদস্যের একটি দল তদন্ত করে দেখছে বিষয়টি। সাইবার বিভাগের কাছ থেকে সন্ধ্যার মধ্যেই রিপোর্ট হাতে পাব।’’ তবে কেন্দ্রের তরফএ এখনও এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। ‘রেকর্ডেড ফিউচার’-এ গবেষকদের মতে, হতে পারে এখনও পর্যন্ত ভারত সরকারও ওই ‘কোড’ খুঁজে পায়নি। বিশদ তথ্য হাতে পেলে আগামিদিনে নিশ্চয়ই তা প্রকাশ করা হবে। তাতে আগামিদিনে ইন্দো-চিন কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর তরফে দিল্লি এবং বেজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু কোনও পক্ষই এ নিয়ে মুখ খোলেনি বলে জানিয়েছে তারা। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে তারা জানিয়েছে, করোনা বিপর্যয়ে যখন ঝুঝছে গোটা বিশ্ব, সেই সময় ২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সরকারের মদতপুষ্ট হ্যাকাররা উহানে করোনা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করা একটি সংস্থার ইমেল হ্যাক করে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ করে সে দেশের সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা ‘৩৬০ সিকিয়োরিটি টেকনোলজি’। ভারতীয় হ্যাকারদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগও তোলে তারা। তা নিয়ে টানাপড়েনের জেরেই দুই দেশ বিদ্যুৎবিভ্রাট নিয়ে নীরবতা পালন করছে বলেও মনে করছেন অনেকে।

তবে ভারতের বিদ্যুৎ পরিষেবাকে বিকল করে দেওয়ার পিছনে চিনের আরও বড় অভিসন্ধি রয়েছে বলে মনে করছেন কূটনীতিকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, লাদাখে পরিস্থিতি তেতে ওঠার পর মাত্র ৫ দিনে ভারতের বিদ্যুৎ এবং ব্যাঙ্কিং প্রযুক্তির উপর ৪০,৩০০ বার আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে চিনা হ্যাকাররা। ভারতকে চাপে রাখার কৌশল ছিল তাদের। বোঝাতে চাইছিল, সীমান্তে চিনা বাহিনীকে যত পিছু হটাবে ভারতীয় সেনা, ততই প্রযুক্তিগত ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে ভারতকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে চিন। সে ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি প্রদর্শনেরও প্রয়োজন পড়বে না। বিদ্যুৎ পরিষেবায় চিনা অনুপ্রবেশ নিয়ে এখনও পর্যন্ত দিল্লির তরফে কোনও তথ্য সামনে আনা হয়নি। তবে প্রযুক্তিক্ষেত্রে এখনও চিনা যন্ত্রাংশের উপরই নির্ভরশীল ভারত। সে ক্ষেত্রে চিনের পক্ষে সাইবার হানা চালানো আরও সহজসাধ্য হয়ে উঠছে। দেশের নিরাপত্তা নিয়ে তাই স্বাভাবিক ভাবেই মেঘ জমছে সাউথ ব্লকের আকাশে। যে কারণে যন্ত্রাংশের জন্য চিনের উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement