নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
২০১৬ সালে সার্ক সম্মেলনের আগে সাউথ ব্লক বজ্র নির্ঘোষে জানিয়েছিল যে, যে দেশ অন্য দেশে প্রবেশ করে সন্ত্রাস চালায়, তাদের উপস্থিতিতে সার্কে যোগদান সম্ভব নয়। অতএব বয়কট ছাড়া পন্থা নেই। ঘটনাচক্রে বাতিল হয় সার্ক।
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, চিনও গত দু’বছর ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে। কিন্তু মোদী সরকারের সেই নির্ঘোষ এ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। শুধু তাই নয়, গালওয়ানে ঢুকে হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া চিনা কমান্ডারকে বেজিং শীতকালীন অলিম্পিক্সের মশালবাহক করার সিদ্ধান্তকে স্রেফ ‘নিন্দনীয়’ বলে ক্ষান্ত দিল বিদেশ মন্ত্রক। সেই সঙ্গে আমেরিকার সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে অলিম্পিক্সের উদ্বোধন অনুষ্ঠান কূটনৈতিক ভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। অর্থাৎ, ভারতের ভুখণ্ডে ঢুকে হত্যাকাণ্ড চালানো চিনা সেনার মশালের আলোয় উদ্ভাসিত অলিম্পিক্সে অংশ নেবেন ভারতীয় ক্রীড়াবিদ।
কূটনেতিক বিশ্লেষকদের মতে, গালওয়ানের সেনাকে মশালবাহকের দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে চিনের জোরালো ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি রয়েছে। বেজিংয়ের দর্পিত বার্তা স্পষ্ট। গালওয়ানে যা হয়েছে তাকেই বৈধতা দেওয়া এবং গৌরবান্বিত করা হয়েছে বিশ্বের চোখের সামনে। অর্থাৎ গত দু’বছর ধরে পূর্ব লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে চিনা সেনা যা করছে, তা বন্ধ হবে না। সেটাই চিনের নীতি। বিশ্বের সামনে বুক ঠুকে তা প্রকাশ করতেও দ্বিধা নেই সে দেশের।
প্রশ্ন উঠছে, প্রায় প্রতিটি জনসভায় এবং বক্তৃতায়, জাতীয়তাবাদের মশাল ওড়ানো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সরকার, চিনের এই মশালের কাছে নিভে গেলেন কেন? কেন সর্বাঙ্গীন বয়কট করে তীব্র নিন্দা করা হল না ওই সিদ্ধান্তের? বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, তা করা হলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াজগতের কাছে ভুল বার্তা যেত। অলিম্পিক্সের মহান আদর্শের অবমাননা হত।
কিন্তু বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, রাজনৈতিক কারণে অলিম্পিক্স পুরোপুরি বয়কট করার নজির তো রয়েছে। ১৯৮০-র মস্কো অলিম্পিক্সে আমেরিকার নেতৃত্বে ৬৫টি দেশ প্রতিযোগিতাতেই যোগ দেয়নি। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণের প্রতিবাদ হিসাবে সেই বয়কট করা হয়। এরপর ১৯৮৪ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক্সও পাল্টা বয়কট করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ১৪টি দেশ।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ভারত সর্বাঙ্গীন বয়কটের রাস্তায় তো হাঁটেইনি, বরং নভেম্বর মাসে আরআইসি (রাশিয়া-ভারত-চিন) সম্মেলনে বেজিং অলিম্পিক্সে সর্বাঙ্গীন যোগদানের কথাই বলেছিল। কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, রাশিয়ার সুর সুর মিলিয়ে যখন আরআইসি-তে ভারত এ কথা বলছে, তখনও পূর্ব লাদাখে ঢুকে বসে রয়েছে লাল ফৌজ। দফায় দফায় সামরিক এবং কূটনৈতিক বৈঠকের পরেও চিনের পশ্চাদপসরণের নামগন্ধ নেই। বরং অরুণাচলের সীমান্তে গোটা চিনা গ্রাম বানিয়ে ফেলার রিপোর্ট হজম করতে হচ্ছে সাউথ ব্লককে।
সম্প্রতি সংসদে এবং ধারাবাহিক ভাবে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মোদী সরকারের চিনা নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। উত্তরপ্রদেশে ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ সিংহ যাদবও অভিযোগ তুলছেন, পাকিস্তানকে প্রধান শত্রু বানিয়ে রাজনৈতিক লাভ কুড়োচ্ছে মোদী সরকার। কিন্তু চিনের কাছে তারা জুজু। শুক্রবারও সংসদে কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীর চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর সামনেই বলেন, চিনা সেনা কোথায় ঢুকে বসে আছে, তার জবাব দিতে হবে নরেন্দ্র মোদীকে। কেন সরকার এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলছে না। তাঁর বক্তব্য, এটাও মোদীকে স্বীকার করে নিতে হবে যে চিনের অশুভ অভিপ্রায় বুঝতে তাঁর ভুল হয়েছিল। উহান থেকে মমল্লপুরম— তিনি চিনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শান্তির পায়রা উডি়য়েছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, চিনের এই কড়া ভারত-বিরোধী সিদ্ধান্তের পরেও নয়াদিল্লির তুলনামূলক ‘নরম’ প্রতিবাদ নিয়ে কেন্দ্রের রাজনৈতিক অস্বস্তিই শুধু বাড়বে না। চিন আরও ঘাড়ে চেপে বসবে অদূর ভবিষ্যতে। অলিম্পিক্সের আদর্শকে সম্মান জানিয়ে ভারত তা হলে প্রতিবাদ বা কড়া জবাবের পন্থা ভাবতে পারত। তেমন মনোভাবের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি।