অনলাইন আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র আয়োজন করতে হলে আলোচ্যসূচি এবং আলোচকদের নাম আগাম জানিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। ছবি: সংগৃহীত।
করোনা-কালে আলোচনার টেবিল থেকে সেমিনারের মঞ্চ সরে গিয়েছে ইন্টারনেটের দেয়ালে, সেখানে ভূগোলের বেড়া ডিঙিয়ে আলোচনায় মাতছেন দেশ-বিদেশের অধ্যাপক-গবেষকরা। আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের এই ভরা মরসুমে এ বার আলোচ্যসূচি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিধির বাঁধন আরোপ করছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক। ১৫ই জানুয়ারি প্রকাশিত এই নয়া নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ভারতের নিরাপত্তা এবং সীমান্ত বিষয়ক কোনও আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র অনলাইনে করা যাবে না। সেখানে আলোচনা হতে পারবে না জম্মু-কাশ্মীর, লাদাখ বা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি নিয়ে।
বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করেই এই নয়া বিধি ঠিক করেছে শিক্ষা মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের যে কোনও মন্ত্রক, সরকারি দফতর, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, কেন্দ্রীয় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি এবং সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তরফে কোনও অনলাইন আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র আয়োজন করতে হলে আলোচ্যসূচি এবং আলোচকদের নাম আগাম জানিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন দেওয়ার সময় মন্ত্রক খতিয়ে দেখবে, আলোচনার বিষয় যেন ভারতের নিরাপত্তা, সীমান্ত, জম্মু-কাশ্মীর, লাদাখ বা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি নিয়ে না-হয়। ভারতের একান্ত অভ্যন্তরীণ কোনও বিষয় নিয়েই যেন না-হয়।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও কী ধরনের তথ্য-পরিসংখ্যান-সারণি আদানপ্রদান হতে চলেছে, সেটা খতিয়ে দেখা হবে। ভারতের মানচিত্র, পতাকা, জাতীয় অভিজ্ঞান যেন নির্ভুল ভাবে তুলে ধরা হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ওয়েবিনার করার জন্য যে অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে, তা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখতে হবে, তার সার্ভার যেন কোনও মতেই ভারত-বিরোধী দেশ বা সংস্থার মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণাধীন না-হয়। সার্বিক ভাবেও ওই আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র যেন ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইন, তথ্য-নিরাপত্তা, সংবেদনশীল তথ্য এবং ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার মাপকাঠি মেনে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের আন্ডারসেক্রেটারি সরোজকুমার চৌধুরি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের পক্ষে এই নির্দেশিকা জারি করেছেন। অফলাইন সেমিনারের ক্ষেত্রে চলতি বিধিই বজায় থাকছে। সেখানে আগে থেকেই ভারতের নিরাপত্তা, সীমান্ত, জম্মু-কাশ্মীর, লাদাখ বা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি নিয়ে আলোচনার জন্য আগাম অনুমতি লাগত। এ ছাড়া বক্তা হিসেবে ওই আলোচনাসভায় কারা থাকবেন তাঁদের নাম, পরিচয় সবই বিদেশ মন্ত্রককে আগাম জানিয়ে অনুমতি নিতে হত। বিদেশি আর্থিক সাহায্যে যদি কোনও সভা বা প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করা হয়, তা-ও
আগাম জানাতে হত। সেই ব্যবস্থাই বজায় থাকবে। এই সব আলোচনায় কেন্দ্র এবং রাজ্যের মন্ত্রী, সাংবিধানিক পদাধিকারী, সরকারি আধিকারিক, বিজ্ঞানী, ডাক্তার—- এঁদের যোগদানের ক্ষেত্রে আগের মতোই বিদেশ মন্ত্রকের অনুমতি নিতে হবে। অনুমোদিত অনলাইন আলোচনা, প্রশিক্ষণ সভার অনলাইন লিঙ্ক বিদেশ মন্ত্রকে জমা দিতে হবে। কেন্দ্রের দাবি, অফলাইন সেমিনারে যোগ দিতে বিদেশ থেকে এলে ভিসা নিয়ে আসতে হত। অনলাইনেও তাই আগাম অনুমতি প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক আলোচনার নেট-মঞ্চকে এ ভাবে বিধিনিষেধে বেঁধে কেন্দ্র মুক্ত চিন্তার আদানপ্রদানের ক্ষেত্রকেই সঙ্কুচিত করতে চাইছে কি না, এই প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক এবং প্রাক্তন সাংসদ সুগত বসুর মন্তব্য, ‘‘এই নির্দেশ শিক্ষার স্বাধীনতায় আঘাত।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ-উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্তের মন্তব্য, ‘‘এ সব শিক্ষার মুক্ত আকাশকে ঢেকে দিয়ে সব কিছুই কেন্দ্রের অধীনে নিয়ে
যাওয়ার চেষ্টা।’’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি কুটা-র সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পার্থিব বসু বলেন, ‘‘গবেষণাকে দেশের গণ্ডিতে আটকানো যায় না।’’ চাইলে যে কোনও বিষয়কেই সংবেদনশীল তকমা দিয়ে তার আলোচনা আটকে দেওয়ার সুযোগ এই বিধিতে থাকছে বলে দাবি করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি জুটা-র সাধারণ সম্পাদক এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, ‘‘আমরা এই নির্দেশের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছি।’’