কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের জন্য পদক্ষেপ ঘোষণা নির্মলা সীতারামনের। ছবি: পিটিআই
লকডাউনের ধাক্কা থেকে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বাজারে কেনাকাটা বাড়ানোর দরকার। সেই লক্ষ্যে উৎসবের মরসুমে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের জন্য ১০ হাজার টাকা করে অগ্রিম দেওয়ার কথা ঘোষণা করল নরেন্দ্র মোদী সরকার। উপর থেকে নিচুতলা— প্রায় ৪৮.৩৪ লক্ষ সরকারি কর্মীর সকলেই এই টাকা পাবেন। টাকা অবশ্য নগদে পাওয়া যাবে না। শুধু স্টেট ব্যাঙ্কের রুপে কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটা করা যাবে। টাকা শোধ করতে হবে সর্বোচ্চ ১০টি কিস্তিতে।
কোভিডের জন্য অধিকাংশ মানুষই এ বার পুজো বা শীতের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা শিকেয় তুলে রেখেছেন। তাঁদের এলটিসি বাবদ প্রাপ্য নগদে দেওয়ার প্রকল্পও চালু করছে কেন্দ্র। যদিও সেই টাকা পেতে রেল বা বিমান ভাড়া বাবদ প্রাপ্যের তিন গুণ এবং লিভ এনক্যাশমেন্ট বাবদ প্রাপ্য পুরো টাকা খরচ করে টিভি-ফ্রিজের মতো বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম কিনতে হবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন, “যদি রাজ্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলি তাদের কর্মীদের এলটিসি নগদে নেওয়ার সুবিধা দেয়, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্র কর ছাড় দেবে।’’
এর পাশাপাশি, বাজারে চাহিদা বাড়াতে রাস্তা, নগরোন্নয়নের মতো পরিকাঠামোয় এই অর্থ-বর্ষে বাড়তি ২৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করার কথা বলেছেন সীতারামন। জানিয়েছেন, পরিকাঠামোয় খরচের জন্য রাজ্যগুলিকে ৫০ বছরের জন্য ১২ হাজার কোটি টাকা বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দাবি, ‘‘এর ফলে বাজারে অন্তত ৭৩ হাজার কোটি টাকার চাহিদা তৈরি হবে। অঙ্কটা ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাপিয়ে যেতে পারে।”
আরও পড়ুন: এফআইআর নিয়ে নাটক, আদালতে প্রশ্ন, ‘আপনার মেয়ে হলে পারতেন’
মোদী সরকারের এই দাওয়াইয়ে আখেরে অর্থনীতির কতখানি লাভ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, মোদী সরকার আসলে মাছের তেলে মাছ ভাজছে। একই সঙ্গে তেলা মাথায় তেল দিচ্ছে। প্রথমত, এই সব দাওয়াইয়ের আর্থিক দায় তেমন নয়। অগ্রিমের টাকা আখেরে শোধ করতে হবে। আর এলটিসি-র টাকা এমনিতেই দিতে হত। ফলে এই দুই খাতে বাড়তি খরচ কিছু নেই। অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের চাকরি বা বেতন নিয়ে কোনও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি। তাঁরা লকডাউনের সময় খরচ করতে না পেরে টাকা জমিয়েছেন। এখন তাঁদের হাতে সরকার আরও টাকা তুলে দিচ্ছে। যেটা তাঁদের এমনিতেই প্রাপ্য ছিল। তা-ই দিয়ে সরকার দাবি করছে, বাজারে চাহিদা বাড়াতে পদক্ষেপ করা হল।
অর্থনীতিকে প্রাক-কোভিড যুগে ফেরাতে আগামী তিন বছরে ১০ লক্ষ কোটি টাকার দাওয়াইয়ের সুপারিশ করেছিলেন দেশের প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন। এ দিন তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই অগ্রিম, এলটিসি, এ সবে অর্থনীতিতে বিশেষ ফারাক পড়বে না। কারণ যাঁদের টাকা দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের তো রুটিরুজি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি।’’ তাঁর মতে, বেসরকারি সংস্থাগুলিতে এমনিতেই নগদের টান। তারা এলটিসি প্রকল্প নিতে উৎসাহিত হবে না।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, পুজোর মরসুমে ১০ হাজার টাকা অগ্রিম পেয়ে অনেকেই হয়তো খরচ করতে পারেন। তাতে সাময়িক ভাবে বাজারে কেনাকাটা বাড়বে। সরকারেরও জিএসটি থেকে বাড়তি আদায় হবে। কিন্তু উৎসবের মরসুমের পরেই তা মিইয়ে যাবে। আর এলটিসি-র টাকার জন্য রেল-বিমান ভাড়া বাবদ প্রাপ্যের তিন গুণ পকেট থেকে কত জন খরচ করতে চাইবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কংগ্রেস নেতা গৌরব বল্লভ বলেন, ‘‘অর্থমন্ত্রী সরকারি কর্মীদের নিজেদের টাকা কী ভাবে খরচ করতে হবে তা বলে দিয়ে তাকে চাহিদা বাড়ানোর দাওয়াই বলে দাবি করছেন।’’ অর্থমন্ত্রীর অবশ্য যুক্তি, কোভিডের ফলে কেউই এখন বেড়াতে যেতে পারছেন না। ফলে এলটিসি নিতে পারছেন না। তাই প্রাপ্য টাকা নগদে নিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হল। কিন্তু এতে হোটেল-পর্যটন শিল্পে ধাক্কা লাগবে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে শিল্পমহল।
আরও পড়ুন: রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় ভেলোরের হাসপাতাল
অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য, আজকের ঘোষণায় কেন্দ্রের আর্থিক দায়ভার মাত্র ২৫ হাজার কোটি টাকা। যা পরিকাঠামো খাতে খরচ হবে। রাজ্যগুলিকে যে টাকা দেওয়া হবে, সেটাও ঋণ, এবং সেই টাকা কে দেবে, তা এ দিন স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে সব মিলিয়ে মোদী সরকারকে এক পয়সাও বাড়তি ঋণ করতে হবে না।
পরিকাঠামো খাতে রাজ্যগুলির জন্য যে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণের ঘোষণা হয়েছে, তা-ও খুবই যৎসামান্য বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। আইসিআরএ-র মুখ্য অর্থনীতিবিদ অদিতি নায়ারের মতে, রাজ্যগুলির জন্য ৫০ বছরের যে সুদ-মুক্ত ঋণ ঘোষণা হয়েছে, তাতে এক একটি রাজ্য খুবই সামান্য টাকা পাবে। যেমন উত্তরপ্রদেশ পাবে মাত্র ১৪৬২ কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গ ৫৬৪ কোটি টাকা পেতে পারে। এই টাকায় পরিকাঠামোয় বিরাট কোনও জোয়ার আসবে না। খুব বেশি হলে ঠিকাদারদের বকেয়া পাওনা তাড়াতাড়ি মেটাতে সুবিধা হতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এর থেকে গরিব বা রুটিরুজি হারানো মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দিলে তার পুরোটাই খরচ হত। মানুষেরও সুরাহা মিলত। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে রাজকোষ থেকে বাড়তি টাকা খরচ করতে হত। টানাটানির সংসারে কেন্দ্রের নিজের খরচই ধার করে চলছে। আরও খরচের অর্থ আরও ধার। সে দিকে যে অর্থমন্ত্রী হাঁটতে চাননি, তা তিনি নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। নির্মলা বলেন, ‘‘বাজারে চাহিদা বাড়াতে সরকার এমন কিছু করতে চায়নি, যাতে ঋণের বোঝা মাথায় চেপে বসে। বাড়তি নগদ জোগানের ফলে বাজারে মূল্যবৃদ্ধি বেড়ে গিয়ে তা সাধারণ মানুষেরও মাথাব্যথা হয়ে ওঠে।’’ অর্থ মন্ত্রকের যুক্তি, এমনিতেই সেপ্টেম্বরে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.৩৪%-এ পৌঁছেছে।
সীতারামনের এ দিনের ঘোষণাকে সময়োচিত আখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর টুইট, ‘এর ফলে বাজারে বিক্রিবাটা এবং মূলধনী খাতে ব্যয় বাড়বে। আমাদের অর্থনীতিতে চাহিদাও বাড়বে।’