নেতাজি রহস্যভেদে অবশেষে তৎপর হল কেন্দ্র।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে সুভাষচন্দ্র বসুর নামে থাকা গোপন নথি জনসমক্ষে আনা যায় কি না তা খতিয়ে দেখতে আজ আন্তঃমন্ত্রক একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ক্যাবিনেট সচিবের নেতৃত্বে ওই কমিটিতে থাকবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সদস্যরা। এ ছাড়া, গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আই বি) ও রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইঙ্গ (র)-এর পদস্থ কর্তারাও থাকবেন ওই কমিটিতে। নেতাজির নামে থাকা ফাইলগুলোর বন্দিদশা শেষ পর্যন্ত ঘুচবে কি না, সেই সিদ্ধান্তই নেবে ওই কমিটি। কালই ওই কমিটির প্রথম বৈঠক।
কমিটি তৈরি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ফাইলগুলো জনসমক্ষে আদৌ আসবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বিজেপির একাংশের বক্তব্য, এর আগে বাজপেয়ী জমানাতেও একবার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ফাইলগুলো এতটাই স্পর্শকাতর যে সেগুলো সামনে এলে বিভিন্ন মিত্র দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে পারে। সেই আশঙ্কাতেই এই উদ্যোগ ধামাচাপা পড়ে যায়।
এর একটি বিপরীত মতও রয়েছে। তাদের যুক্তি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন করে শক্তির বিন্যাস চলছিল। ইংল্যান্ডের পরিবর্তে নতুন শক্তি হিসেবে মাথাচড়া দিচ্ছিল আমেরিকা-রাশিয়া। তখনকার আর বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তা ছাড়া, বর্তমান সময়ে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ভর করে অর্থনীতির উপর। ফলে নেতাজির নামে ফাইল প্রকাশ হলেই অন্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে এমন যুক্তি মানতে চাইছেন না তৃণমূলের সাংসদ তথা নেতাজির প্রপৌত্র সুগত বসু। তাঁর কথায়, ‘‘এ সব অজুহাত মাত্র।’’
সম্প্রতি কেন্দ্র নেতাজির নামে থাকা দু’টি গোপন ফাইল সর্বসমক্ষে আনার পরে এই বিতর্কের সূত্রপাত। ন্যাশনাল আর্কাইভে থাকা ওই ফাইল দু’টি থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার পরে প্রায় দু’দশক (১৯৪৮-১৯৬৮) কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারের নির্দেশে সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবারের উপর নজরদারি করে গিয়েছেন গোয়েন্দারা। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দেশে। যথাযথ তদন্তের দাবি করে বিজেপিও। এরই মধ্যে গতকাল জার্মানিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সম্মানে একটি সভার আয়োজন করেছিলেন সে দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত বিজয় গোখলে। ইন্দো-জার্মান বাণিজ্য সংগঠনের সভাপতি, নেতাজির প্রপৌত্র সূর্যকুমার বসুও সেই সভায় ছিলেন। সেখানেই তিনি মোদীকে অনুরোধ করেন, নেতাজির নামে থাকা বাকি ফাইলগুলো প্রকাশ্যে আনা হোক। তখনই তাঁকে নেতাজি সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য প্রকাশ করা
হবে বলে আশ্বাস দেন মোদী। মূলত তাঁরই নির্দেশে আজ ওই কমিটি গঠন করে সরকার।
সূত্রের খবর, ভারত সরকারের হেফাজতে বর্তমানে নেতাজি সম্পর্কিত ৮৩টি গোপন ফাইল রয়েছে। মতান্তরে ৮৯টি। যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সবিচালয় বা পিএমও-র কাছে রয়েছে ৫৮টি ফাইল। বাকি ২৫টি ফাইল রয়েছে বিদেশ মন্ত্রকের হেফাজতে। সরকারের গোপনীয়তা আইনের আওতায় রয়েছে বলে ওই ফাইলগুলি এ যাবৎ জনসমক্ষে আনেনি কোনও সরকারই। যদিও ওই আইনের ধারা বলছে, যে কোনও সরকারি গোপন নথিই ত্রিশ বছর পরে আর গোপন থাকে না। তখন সেগুলো প্রকাশ করতে কোনও বাধা থাকার কথা নয়।
কিন্তু সে নিয়ম খাটেনি নেতাজির ক্ষেত্রে। স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরেও গোপনীয়তার দশা থেকে মুক্তি পায়নি নেতাজি সম্পর্কিত ফাইলগুলো। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বিভিন্ন ব্যক্তি তথ্য জানার অধিকারে জানতে চেয়েছেন। সংসদে এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন একাধিক সাংসদ। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই একই জবাব দিয়ে জানানো হয়েছে, নেতাজি সম্পর্কিত গোপন ফাইল প্রকাশিত হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।
এখন বিষয়টি নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নেওয়ায় আশায় বুক বাঁধছেন উৎসাহীরা। বিশেষ করে বসু পরিবারের সদস্যেরা। সুগতবাবুর বক্তব্য, ‘‘সমস্ত ফাইল মানুষের সামনে আসা উচিত। এত দিন পরে একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করি, ওই কমিটি দ্রুত তাদের সিদ্ধান্ত নেবে।’’
গোটা বিষয়টিতে সব চেয়ে অস্বস্তিতে পড়েছে কংগ্রেস শিবির। কারণ ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নির্দেশেই নেতাজির পরিবারের বিরুদ্ধে চরবৃত্তি চালিয়ে গিয়েছিলেন গোয়েন্দারা। কংগ্রেসের পাল্টা অভিযোগ, দু’টি মাত্র ফাইল প্রকাশ করে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার পরিকল্পিত ভাবে রাজনীতি করছে। আজ বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মা দাবি করেন, ‘‘সমস্ত গোপন ফাইল প্রকাশ করে এ নিয়ে সংসদে একটি বিতর্ক হোক। তা হলেই প্রকৃত সত্য সামনে আসবে।’’