ফি-বছরই লেগে থাকে কোনও না কোনও ভোট। ভোট মানে বিরাট খরচ। সে খরচও যাবে আমজনতার পকেট থেকে। ভোট মানে অনন্ত প্রতীক্ষাও। কবে শেষ হবে ভোট, তারপর হবে সরকারের নতুন ঘোষণা। তারপর ধীরে ধীরে নীচে চুঁইয়ে পড়বে উন্নয়নের টাকা।
প্রতি বছরের এই ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি দিতেই এ বারে নতুন প্রস্তাব কার্যকর করতে নামছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। গোটা দেশে পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা নির্বাচন হবে একই সময়ে। প্রতি পাঁচ বছর পর বছরের নির্দিষ্ট সময়ে গোটা দেশে সব ভোট হবে একসঙ্গে। তার জন্য যদি ২-৩ মাস সময় লাগে তো লাগুক। কিন্তু প্রত্যেক বছর কোনও না কোনও ভোটের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে। অন্তত পাঁচ বছর গুছিয়ে নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের কাজ ঢেলে করা যাবে। ভোট বলে আর পদে পদে হোঁচট খেতে হবে না।
বিজেপি-র শীর্ষ সূত্রের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই বিষয়টি কার্যকর করার জন্য খুবই তৎপর হয়েছেন। সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞদের মতামতও নিয়েছেন। দলের সভাপতি অমিত শাহের সঙ্গেও তিনি এ বিষয়ে সবিস্তার কথা বলেছেন। তার ভিত্তিতে দলের পক্ষ থেকে শীর্ষস্তরের নেতারা ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনের কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা সেরে ফেলেছেন। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্ব জানেন, শুধু সরকার উদ্যোগী হলেই এই বিষয়টি রূপায়ণ করা যাবে না। তার জন্য সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিও নিতে হবে। তাই নির্বাচন কমিশনের কাছেই আর্জি জানানো হয়েছে, তারা যেন শীঘ্রই এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ করে।
বিজেপি-র এক শীর্ষনেতা বলেন, ‘‘আশা করি, এই বিষয়টি কার্যকর করার জন্য বাকি দলের কোনও আপত্তি হবে না। কারণ, সকলেই প্রত্যেক বছরের ভোটে ভুক্তভোগী। শুধু কেন্দ্র নয়, ফি-বছর কোনও না কোনও পঞ্চায়েত, পুরসভা— হরেক রকমের ভোটে নাজেহাল রাজ্য সরকারও। সাধারণ মানুষও লাগাতার এই ভোট-পার্বণে বিরক্ত।’’ এক বার নির্বাচন কমিশন এই বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে কথা বলা শুরু করলে শীঘ্রই পঞ্চায়েত থেকে লোকসভার ভোট একসঙ্গে করার ব্যবস্থা কার্যকর করে ফেলতে চায় মোদী সরকার।
বিজেপি-র প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী বহু বছর ধরে এই বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার। ইউপিএ জমানায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও তাঁর সরকারের সেনাপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও সবিস্তার এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। লোকসভা ও বিধানসভার মেয়াদ নির্ধারিত সময়ে বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেসের এই দুই শীর্ষনেতাও সম্মত হয়েছিলেন বলে আডবাণী দাবি করেছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে এ ব্যাপারে আর উদ্যোগী হয়নি সরকার। কিন্তু মোদী সরকার এ বারে এটিকে গুরুত্ব দিয়েই রূপায়ণ করতে চাইছে।
প্রতি চার বছরে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। সেখানকার আইন মোতাবেক পরবর্তী নির্বাচনের সঠিক দিনক্ষণও আগেভাগে নির্ধারিত হয়ে যায়। অধিকাংশ ইওরোপীয় গণতন্ত্রেও এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। ভারতের সংবিধান বানানোর সময় ব্রিটিশ ঘরানার আদল নেওয়া হয়েছিল। যার ফলে সরকারের হাতে এই মেয়াদ কমানোর অধিকার তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন ব্রিটেনেও নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে সংসদের নির্বাচন করানো হচ্ছে।
ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এই ব্যবস্থা কার্যকর করা বরং আরও বেশি কঠিন কাজ। স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশক পাঁচ বছরের ব্যবধানে দিব্য ভোট হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৫২ সালের পর থেকে আরও তিন বার পাঁচ বছরের ব্যবধানে লোকসভা নির্বাচন হলেও ’৬৭ সালের পর থেকে এই হিসেব গোলাতে শুরু করে। ’৬৭ সালের পর চার বছরের মাথায় ১৯৭১ সালেই লোকসভা ভোট হয়ে যায়। তারপরই প্রতি বছর কোনও না কোনও ভোট চাপতে থাকে আমজনতার মাথায়। এই বিষয়টিই এ বারে বদলাতে চাইছে মোদী সরকার।
তবে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার বিরুদ্ধেও যুক্তি রয়েছে। যেমন অনেকে মনে করেন, সব কিছুর মেয়াদ পাঁচ বছর বেঁধে দেওয়ার অর্থ, দেদার দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া। কোনও সরকার যদি জানে, পাঁচ বছরে কেউ তাদের হঠাতে পারবে না, তা হলে দেদার দুর্নীতি করলেও কারও কিছু করার থাকবে না। কিন্তু এর বিপক্ষ মত হল, সাধারণ নিয়মে এখনও পাঁচ বছর কোনও সরকারের মেয়াদ থাকে। যদি সরকারের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে। সুশাসন দিতে না পারলে তো পরের ভোটে মানুষ তাদের শিক্ষা দেবে। অন্তত সময় বেঁধে দিলে কেউ রাজনৈতিক কারণে সমর্থন কেড়ে নিলে সরকারের অস্থিরতা তৈরি করতে পারবে না। বাকি সব শাসক দলই চাইবে পরের বার জিতে আসতে। ফলে তারা আরও বেশি ভাল করে কাজ করতে চাইবে মানুষের স্বার্থে।