ফাইল চিত্র।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বলে, আমলা যখন রাজ্যে নিযুক্ত, তখন তিনি রাজ্যের আর যখন কেন্দ্রের কাজে যুক্ত, তখন তিনি কেন্দ্রের। কিন্তু কেন্দ্রের সাম্প্রতিক উদ্যোগে সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাই বিপন্ন হতে বসেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন প্রশাসনিক পর্যবেক্ষক শিবিরের অনেকে। তাঁরা আভাস পেয়েছেন, ১৯৫৪ সালের আইএএস (ক্যাডার) আইন সংশোধন করে কেন্দ্র আমলাকুলের পুরো রাশ নিজেদের হাতে নিতে চাইছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ইতিমধ্যে এই ‘তথ্য’ পেয়েছেন বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। রাজ্য সরকার এই বিষয়ে তাদের আপত্তির কথা জানাচ্ছে কেন্দ্রকে। আইন সংশোধন করে কেন্দ্র অফিসার নিয়ন্ত্রণের পুরো দায়িত্ব নিলে রাজ্যের সঙ্গে তাদের সংঘাত কোনও পর্যায়ে পৌঁছবে, তা নিয়ে তীব্র জল্পনা চলছে প্রশাসনের অন্দরে। বিজ্ঞপ্তি-বিবৃতিতে, আইন-আদালতে টানাপড়েন সমানে চলেছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের বড় অংশের বক্তব্য, কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, সরকার তো জনগণের সেবক। আমলারাও। আমলা-অফিসারদের নিয়ে বিবাদ বা দড়ি টানাটানির অবসান ঘটাতে কেন্দ্র এখন যা করতে চলেছে, তাতে সেই জনগণের উপকার, না, অপকার?
প্রশাসনিক মহল মনে করিয়ে দিচ্ছে, কেন্দ্রের এমন পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রচণ্ড ধাক্কা খেতে পারে। সে-ক্ষেত্রে আইনের দ্বারস্থ হতে পারে বিরোধী রাজ্যগুলি। শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক, জনস্বার্থে এমন পদক্ষেপ কতটা লাভজনক বা ক্ষতিকর, তা নিয়ে প্রবল চর্চা চলছে আমলা মহলে।
আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের উপরে ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর অধিকার কার, তা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ দীর্ঘ কালের। কেন্দ্র মনে করে, সর্বভারতীয় চাকরিতে নিযুক্ত আইএএস-দের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই রয়েছে এবং থাকা উচিত। রাজ্যের দাবি, রাজ্য ক্যাডারে থাকা আইএএস-দের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তাদের হাতে। এ নিয়ে সংঘাতের ঘটনাও ভূরি ভূরি।
দৃষ্টান্ত ১: গত বিধানসভা ভোটের আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনার পরে রাজ্যের তিন আইপিএস অফিসারকে ডেপুটেশনে চেয়েছিল কেন্দ্র। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ওই তিন অফিসারকে ছাড়েনি রাজ্য।
দৃষ্টান্ত ২: কলাইকুন্ডায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘বৈঠক-জটিলতা’র পরে তৎকালীন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে কর্মিবর্গ এবং প্রশিক্ষণ মন্ত্রকে (ডিওপিটি) যোগদানের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্র। তাতেও সম্মতি দেয়নি রাজ্য সরকার।
কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনের প্রশ্নে সাধারণ ভাবে রাজ্যের মতামত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন আমলা মহলের অনেকে। তাঁদের যুক্তি, রাজ্যের সম্মতি বা ছাড়পত্র না-থাকলে কোনও আইএএস বা আইপিএস অফিসার কেন্দ্রের ডেপুটেশনে যোগ দিতে পারেন না। কিন্তু অনেকের বক্তব্য, কেন্দ্র ডেপুটেশনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বজায় রাখলে সার্ভিস রুলের ৬(১) ধারা অনুযায়ী রাজ্যের কিছু করার নেই। দেশের রাষ্ট্রপতির দ্বারা নিযুক্ত সর্বভারতীয় ক্যাডার অফিসারদের নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ বাধলে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই মানতে হবে রাজ্যকে। উপরের উদাহরণগুলির ক্ষেত্রেও আইনের এই ধারা প্রয়োগ করেছিল কেন্দ্র। কিন্তু রাজ্য এক্তিয়ারের প্রশ্নে অনড় থাকায় কেন্দ্র ওই অফিসারদের টেনে নিতে পারেনি। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করছেন, ‘বিবাদ’ এড়াতে ক্যাডার আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার বাধ্যতামূলক প্রয়োগের পথেই হাঁটতে চাইছে কেন্দ্র। এক বার আইএএস-দের ক্ষেত্রে সংশোধিত আইন চালু করা গেলে আগামী দিনে হয়তো আইপিএস অফিসারদের ক্ষেত্রেও তেমনই
পদক্ষেপ করবে কেন্দ্র।
ক্যাডার আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের বক্তব্য, নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক আইএএস-কে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে পাঠানোর কথা সব রাজ্যেরই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা তা করে না। ফলে কেন্দ্রে অফিসারের সংখ্যা সব সময়েই কম থাকে। তাই মূলত তিনটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছে কেন্দ্র। ১) রাজ্য থেকে কেন্দ্রের ডেপুটেশনে নির্দিষ্ট সংখ্যক অফিসার পাঠানোর রীতি বজায় রাখতেই হবে। ২) অন্যথায় রাজ্যের সঙ্গে কথা বলে অফিসারদের ডেপুটেশনে চাইবে কেন্দ্র। রাজ্য আপত্তি করলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের টেনে (‘স্ট্যান্ড রিলিভড’) নেওয়া হবে। ৩) তার বাইরেও কোনও অফিসারকে নির্দিষ্ট কোনও পদে বসাতে চাইলে কেন্দ্রের প্রস্তাব মানতে হবে রাজ্যকে।
কেন্দ্রের এই উদ্যোগে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন প্রাক্তন আমলারা। প্রাক্তন এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, সংবিধান প্রণয়নের সময় এই ধরনের দ্বন্দ্বের কোনও আঁচ মেলেনি। কারণ, আইএএস-রা সর্বভারতীয় চাকরি করেন। কিন্তু এখন ব্যাপারটা উল্টো হচ্ছে। রাজ্যও অনেক ইচ্ছুক অফিসারকে কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে ছাড়তে চাইছে না। আবার কেন্দ্রও জোর করে ডেপুটেশনে অফিসার নিতে চায়। প্রশ্নটা দোষ-গুণের নয়। এতে পারস্পরিক সম্পর্কের জায়গাটা ধাক্কা খাচ্ছে বলে মনে করেন ওই প্রাক্তন কর্তা। অন্য এক প্রাক্তন শীর্ষ কর্তা বলেন, “এটা কেন্দ্রের ভুল পদক্ষেপ। অনেক রাজ্যই এতে আপত্তি করছে। কেন্দ্র একতরফা ভাবে এই নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখলে রাজ্যের অফিসারেরা পুরোপুরি কেন্দ্রের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন। রাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে সেটা মোটেই সুখকর হবে না। এই উদ্যোগে অফিসারদের অনেকেই ত্রস্ত।” তবে আধিকারিক মহলের ব্যাখ্যা, কেন্দ্রের এমন পদক্ষেপের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথম, কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে আগ্রহী অফিসারেরা খুশি হবেন। দ্বিতীয়, ধাক্কা খেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের মতে, দ্বিতীয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের ব্যাখ্যা, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আইএএস বা আইপিএস-রা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের পরে রাজ্যে যোগ দিলে সেই রাজ্যের সরকারই হয় তাঁর নিয়ন্ত্রক। জনস্বার্থে কাজ করার প্রশ্নে রাজ্য সরকারের নীতি-নির্দেশ মানতে তিনি বাধ্য। ফলে রাজ্য এবং রাজ্য সরকারের প্রতি সেই অফিসারের একটা দায়বদ্ধতা যেমন কাজ করে, তেমনই তাঁর উপরে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার দায়িত্ব সঁপে দিতে শাসকেরও একটা আস্থাভরসা ক্রিয়াশীল থাকে। নিয়ন্ত্রণ পুরো কেন্দ্রের হাতে চলে গেলে অফিসারদের উপরে রাজ্যের শাসকের ভরসার জায়গাটাই ধাক্কা খাবে।