ব্রিজভূষণ শরণ সিংহ। ফাইল চিত্র।
দেশ জুড়ে দাবি উঠলেও এখনই ভারতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি পদ থেকে ব্রিজভূষণ শরণ সিংহকে সরানোর পরিকল্পনা নেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের। শাসক শিবিরের দাবি, বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতেই ব্রিজভূষণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। অন্য দিকে প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়াতে মহাসম্মেলনের ডাক দিয়েছে উত্তরপ্রদেশের কৃষক সংগঠন ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন। বালিয়ান খাপের নেতা নরেশ টিকায়েত জানিয়েছেন, কুস্তিগিরদের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে আগামিকাল উত্তরপ্রদেশে মুজফফ্রনগরের সৌরাম এলাকায় ওই সম্মেলন ডাকা হয়েছে।
ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনে তাঁর গ্রেফতারির দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে সরব আন্তর্জাতিক পদকজয়ী কুস্তিগিরেরা। বিরোধী রাজনৈতিক দল, কৃষক সংগঠন, দেশের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ কুস্তিগিরদের পাশে থাকলেও গোড়া থেকেই ব্রিজভূষণের পাশে শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সরকার। আজ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম বার বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দিল্লি পুলিশ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করছে। কুস্তিগিরদের উদ্দেশে তাই আমার অনুরোধ, তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’’
কিন্তু অন্য দিকে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই ব্রিজভূষণকে ক্লিনচিট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে। আজ দুপুরে সংবাদমাধ্যমে দিল্লি পুলিশের পক্ষে দাবি করা হয়, ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত যে তদন্ত হয়েছে তাতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিশেষ কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আগামী পনেরো দিনের মধ্যে আদালতে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে চার্জশিট বা চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করবে দিল্লি পুলিশ। সূত্রের মতে, যে নাবালিকার বয়ানের ভিত্তিতে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে পকসো আইনে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, তা-ও খারিজ হওয়ার পথে। অভিযোগকারী ওই নাবালিকা দু’বছর বয়স কম দেখানোয় ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে ওই ধারা তুলে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই কী করে দিল্লি পুলিশ অভিযুক্তকে ক্লিনচিট দিচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দলগুলি। কংগ্রেস নেতা রণদীপ সুরজেওয়ালার মতে, সরকার যে ব্রিজভূষণকে বাঁচাতে তৎপর, তা দিল্লি পুলিশের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। এই নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ার পরে অবশ্য ওই বক্তব্য তাদের সরকারি ভাষ্য নয় বলে দাবি করছে দিল্লি পুলিশ। সন্ধ্যায় বিবৃতি দিয়ে তারা জানায়, ‘‘মহিলা কুস্তিগিরেরা যে অভিযোগ দায়ের করেছেন, সেই তদন্ত চালু রয়েছে। প্রাথমিক একটি রিপোর্টও আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। যে হেতু তদন্ত চলছে, তাই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা আইনত ঠিক নয়।’’
যদিও দিল্লি পুলিশ কার্যত ক্লিনচিট দিয়েছে ধরে নিয়েই ফের ফুঁসে উঠেছেন ব্রিজভূষণ। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরে চার মাস কেটে গিয়েছে। আজও বলছি, একটি অভিযোগও প্রমাণিত হলে আমায় ফাঁসি দেওয়া হোক।’’ কুস্তিগিরদের গঙ্গায় পদক ফেলতে যাওয়াকে ‘নাটক ছাড়া কিছু নয়’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ব্রিজভূষণের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন অযোধ্যা এলাকার বিজেপি নেতৃত্ব। আগামী ৫ জুন অযোধ্যায় জনচেতনা মহার্যালি-র আয়োজন করেছেন ব্রিজভূষণ ও তাঁর সমর্থকেরা। যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়াও উপস্থিত থাকবেন ধর্মগুরুরা। সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনে সরব হবেন ব্রিজভূষণ।
তবে উত্তরপ্রদেশে ব্রিজভূষণের দিকে সমর্থনের হাওয়া থাকলেও, কুস্তিগিরদের ধর্নায় বেশ অস্বস্তিতে হরিয়ানার বিজেপি নেতৃত্ব। আগামী বছর লোকসভার পরেই ওই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। ফলে বিতর্কের দ্রুত মীমাংসা না হলে এই আন্দোলন দলের বিপক্ষে যেতে পারে বলে মনে করছেন হরিয়ানার বিজেপি নেতারা। দল ব্রিজভূষণের পাশে দাঁড়ানোর নীতি নেওয়ায় সরাসরি ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধাচরণ না করে দ্রুত বিষয়টি মেটানোর পক্ষপাতী তাঁরা। বিশেষ করে যে ভাবে কুস্তিগিরেরা পদক বিসর্জনের কথা বলছেন, তাতে দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। হরিয়ানার বিজেপি সাংসদ বিজেন্দ্র সিংহ বলেন, ‘‘বিষয়টি গোড়াতেই মিটিয়ে ফেলা প্রয়োজন ছিল। যে ভাবে কুস্তিগিরেরা পদক বিসর্জনের কথা বলছেন, তা দুর্ভাগ্যজনক। অনেক পরিশ্রম, ঘাম ঝরিয়ে আন্তর্জাতিক পদক জয় সম্ভব হয়। বাধ্য করা না হলে সেই পদক কেউ জলে ফেলে দেওয়ার কথা বলে না।’’
সামনেই রাজস্থান নির্বাচন। সে রাজ্যেও জাঠ সম্প্রদায়ের বড় অংশ বিজেপিকে ভোট দিয়ে থাকেন। কিন্তু কুস্তিগিরদের আন্দোলনে জাঠ ভোট বিজেপির প্রতি বিমুখ হওয়ারও আশঙ্কা দলের অন্দরমহলে। কিন্তু পিছু হটতে নারাজ মোদী সরকার। সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগটদের সঙ্গে যন্তরমন্তরে পুলিশের ধস্তাধস্তির ছবি দেখে শিউরে উঠেছে দেশ। হরিদ্বারের হর কি পৌড়ি ঘাট চত্বরে পদকজয়ীদের পাশে দাঁড়িয়ে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে কৃষক সমাজ। তবু ব্রিজভূষণকে সরানোর প্রশ্নে অনড় সরকার।
শাসক শিবিরের বক্তব্য, ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে সরানোর প্রশ্নই নেই। কারণ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরেই যদি সরিয়ে দেওয়ার নজির তৈরি হয়, তা হলে বিরোধীরা রক্তের স্বাদ পেয়ে যাবেন। পরবর্তী সময়ে কোনও অভিযোগ উঠলেই ব্রিজভূষণের উদাহরণ টেনে পদ থেকে সরানোর দাবি উঠবে।
এর আগে লখিমপুর খেরির কৃষক হত্যার ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা আশিস মিশ্র গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর বাবা তথা স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনিকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানোর দাবি তুলেছিল বিরোধী শিবির। কিন্তু কর্ণপাত করেনি সরকার। ব্রিজভূষণের ক্ষেত্রেও আপাতত সেই নীতি নিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল।