কান্নায় ভেঙে পড়েছেন আখলাকের আত্মীয়েরা। বুধবার। ছবি: রয়টার্স।
ভবিষ্যতে যাতে নয়ডার ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না-হয়, সে ব্যাপারে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে রীতিমতো সতর্ক করে দিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক।
ওই ঘটনার জেরে যাতে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট না-হয়, মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের সরকারকে তার উপরেও কড়া নজর রাখতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে নয়ডার ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে।
সোমবার রাতে নয়ডার দাদরি পরগনার বিসারা গ্রামে ৫০ বছরের মহম্মদ আখলাককে গোমাংস খাওয়ার ‘অপরাধে’ খুন করা হয়। অভিযোগ, আখলাককে খুন করেন তাঁর গ্রামের মানুষই।
তাঁর কন্যা সাজিদা বলেছে, ‘‘রাতের খাওয়া শেষ করে বাবা তখন দোতলায় শুতে গিয়েছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম গ্রামের মন্দিরে মাইক বাজিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে যে আমাদের বাড়িতে গরু মারা হয়েছে।’’ তার মিনিট খানেকের মধ্যেই আক্রমণ। কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই শ’খানেক লোকের ভিড় জমে গিয়েছিল আখলাকের বাড়ির বাইরে। সাজিদার কথায়, কারও হাতে লাঠি। কারও বা পাথর। সে সব নিয়েই দরজা ভেঙে সোজা বাড়ির ভিতর জনতা।
‘‘নৃশংস ভাবে ওরা চড়াও হল আমার দাদার উপরে’’, ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কাঁপছে সাজিদা। পরনে সাদা সালোয়ার। তাতে চাপ-চাপ রক্ত। বাড়ির একতলাতেই পড়াশোনা করছিল ওর ২২ বছরের দাদা, দানিশ। তাঁকে মারধর করে, আসবাবপত্র ভাঙচুর করে সোজা দোতলায় আখলাকের ঘরে।
সাজিদা বলল, ‘‘বাবাকে বাড়ির বাইরের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল ওরা। তার পর পাথর দিয়ে মাথায় আর বুকে মারতে লাগল।’’ কিছু ক্ষণের মধ্যেই মারা যান আখলাক। দানিশ নয়ডার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অবস্থা সঙ্কটজনক।
‘‘ওরা আমাকেও ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। ঠাকুমাকেও মারল,’’ বলেছে সাজিদা। আধ ঘণ্টা চলেছিল এই তাণ্ডব। সাড়ে দশটা নাগাদ পুলিশের সাইরেন শোনা যায়। পড়িমরি করে ছুটে পালায় সবাই।
দশ জনের নামে এফআইআর দায়ের করা হলেও এখনও পর্যন্ত ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই গ্রামের মন্দিরের পুরোহিতকেও আটক করা হয়েছিল। পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তবে গ্রামবাসীদের গ্রেফতার করার জন্য গত কাল সকালে পাশের গ্রাম থেকে অনেকেই পুলিশের উপর চড়াও হয়। পুলিশ জানিয়েছে, গত কালই গ্রেটার নয়ডার বিসরাখ এলাকায় জাতীয় সড়ক অবরোধ করে গ্রামবাসীরা। তাদের দাবি, গো হত্যার ঘটনায় যে বা যারা জড়িত তাদের যেন মৃত্যুদণ্ড হয়। তারা পুড়িয়ে দেয় পুলিশের একটি ভ্যান, মোটরবাইক। পরিস্থিতি সামলাতে গুলি চালাতে বাধ্য হয় পুলিশ। তাতে আহত হয় বছর কুড়ির এক যুবক। যদিও, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণেই বলে জানিয়েছে পুলিশ। কোনও ঝামেলা আটকাতে গাজিয়াবাদ, বুলন্দশহর এবং হাপুর এলাকা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে গ্রামে।
কিন্তু ওর বাবার ‘দোষ’ কী ছিল, তা এখনও বুঝতে পারেনি সাজিদা। ওই গ্রামেরই প্রবীণরা জানিয়েছেন, প্রায় ৭০ বছর ধরে ওখানেই বাস আখলাক এবং তাঁর পরিবারের। বিসরা গ্রামে প্রায় ন’হাজার বাসিন্দার মধ্যে মাত্র দু’টি সংখ্যালঘু পরিবার। কিন্তু সেখানে কোনও হিংসার ঘটনা স্মৃতিতে নেই গ্রামবাসীদের। বরং নানা অনুষ্ঠানে, এমনকী গত ইদেও তাদের বাড়িতে অনেকেই খাওয়া দাওয়া করে গিয়েছে বলে জানিয়েছে সাজিদা। ওর দাবি, ‘‘ফ্রিজে পাঁঠার মাংস ছিল, গরুর মাংস নয়।’’ আর সেই মাংস ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে পুলিশ। ১৯৫৫ সালের এক আইন অনুযায়ী, উত্তরপ্রদেশে গোহত্যা নিষিদ্ধ। পুলিশ জানিয়েছে, এই আইন অমান্য করলে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা ১০০০ টাকা জরিমানা বা দু’টোই হতে পারে।
তবে কে কী খাবে, সেটা নিয়ে কী করে ফতোয়া জারি করা যায়— প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ ব্রায়েন বলেছেন, ‘‘গুজবের বশে ওই ব্যক্তিকে যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা সঙ্ঘ পরিবারের পুরনো কৌশল।’’ কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির মতে, এটা কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। তিনি বলেছেন, ‘‘বিহার ভোট যত এগিয়ে আসবে তত মেরুকরণের রাজনীতি বাড়বে।’’ তাঁর প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী যখন ডিজিটাল ইন্ডিয়া নিয়ে ব্যস্ত, তখন এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি চুপ কেন। পুলিশ এ দিকে জানিয়েছে, ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব আখলাকের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা সাহায্য দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন।