নবান্ন। —ফাইল চিত্র।
বাজার থেকে ধার করা টাকার বেশিরভাগই খরচ হয়ে যাচ্ছে সুদে-আসলে পুরনো ঋণ শোধ করতে। পশ্চিমবঙ্গের রাজকোষের এই সমস্যা নতুন নয়। এ বার রাজ্যের হিসেব-নিকেশ পরীক্ষা করে নতুন অভিযোগ তুলে সিএজি জানাল, গত বিধানসভা ভোটের আগের বছরে স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্প চালাতে গিয়ে বাজেটের বাইরেও ধার করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
সিএজি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০-২১ আর্থিক বছরে এই ধরনের প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকার নিজে ধার না করে বাজেটের হিসাবের বাইরে তা নিয়েছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মাধ্যমে। এর অঙ্ক প্রায় ৪৩১২ কোটি। দেখা যাচ্ছে, বাজেটের হিসেব-নিকেশে এই দেনার তথ্য না থাকলেও, তার দায় এসে পড়েছে রাজ্যের ঘাড়েই।
২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১— এই পাঁচটি অর্থবর্ষে রাজ্যের আয়, ব্যয়, ঘাটতি, ঋণের হিসাব পরীক্ষা করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সিএজি। সেই রিপোর্টে তারা জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজকোষ ঘাটতি বা আয়-ব্যয়ের ফারাক মোট অঙ্কের হিসেবে বাড়ছে। রাজ্যের জিডিপি বা জিএসডিপি-র তুলনাতেও ওই ঘাটতির হার ঊর্ধ্বমুখী। সেই ঘাটতি মেটাতে প্রতি বছরই বিরাট পরিমাণ অর্থ রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে বাজার থেকে ধার করতে হচ্ছে। কিন্তু তারও সিংহভাগ চলে যাচ্ছে পুরনো ধার সুদে-আসলে শোধ করতে। ফলে সড়ক, সেতু-সহ নতুন পরিকাঠামো বা স্থায়ী সম্পদ তৈরির জন্য রাজ্যের হাতে বিশেষ টাকা বেঁচে থাকছে না। সিএজি বলছে, এ ভাবে ধার করা টাকা দিয়েই পুরনো ঋণ শোধ করা বেশিদিন চলতে পারে না।
এর উপরে আবার বাজেটের বাইরে ঋণ করে বিভিন্ন প্রকল্প চালানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিএজি। ২০২১-এর মার্চ পর্যন্ত রাজ্যের রাজকোষের হাল নিয়ে তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ সালে রাজ্যের ছ’টি সরকারি সংস্থার মাধ্যমে রাজ্য সরকার ৪৩১২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যেমন, স্বাস্থ্য দফতরের সংস্থা স্বাস্থ্যসাথী সমিতির মাধ্যমে ৭২০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। তা খরচ হয়েছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে। পশ্চিমবঙ্গ মহিলা উন্নয়ন উদ্যোগের মাধ্যমে ১১২২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে কন্যাশ্রী প্রকল্পের খাতে। একই ভাবে রূপশ্রী প্রকল্পের জন্য ৪৮৫ কোটি টাকা ধার নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তফসিলি জাতি-জনজাতি-ওবিসি উন্নয়ন ও অর্থ নিগমের মাধ্যমে ৪৯১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা ব্যয় করা হয়েছে তফসিলি বন্ধু, জয় জোহার পেনশন প্রকল্পে। চাষিদের জন্য বাংলা স্বাস্থ্য বিমা যোজনা, আদিবাসীদের জয় বাংলা প্রকল্প, লোকপ্রসার প্রকল্পের জন্যও একই ভাবে ধার করা হয়েছে।
সিএজি জানিয়েছে, ২০২০-২১ সালে যে ৪৩১২ কোটি টাকা ধার নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে অনেকখানি শোধ করা হলেও ১০৮৫ কোটি টাকা এখনও বকেয়া। ফলে তা রাজ্য সরকারের ধার শোধের দায়ের খাতায় যোগ হয়েছে। সিএজির বক্তব্য, এ ভাবে ঋণ নেওয়া হলে, বাজেটে তার হিসাব দেখানো হয় না। ফলে বিধানসভার নজরদারিও থাকে না।
এমনিতেই ২০২০-২১ সালে রাজ্যের মোট ঋণের মাত্র ১৭ শতাংশ নতুন পরিকাঠামো নির্মাণে খরচ হয়েছে বলে সিএজি জানিয়েছে। ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ সালের হিসাবনিকাশ পরীক্ষা করে সিএজির বক্তব্য, আগের চার বছরে তাও কখনও নতুন ঋণের ২১ শতাংশ, কখনও ৪২ শতাংশ পরিকাঠামো-সহ মূলধনী খাতে খরচ করা গিয়েছে। কিন্তু ২০২০-২১, অর্থাৎ বিধানসভা ভোটের আগের বছরে নতুন ঋণের ৮০ শতাংশই পুরনো ঋণ সুদে-আসলে শোধ করতে চলে গিয়েছে!
সিএজি রিপোর্ট অনুযায়ী, নতুন ঋণ নিয়ে তা যদি পরিকাঠামোয় খরচ হয়, তাতে অর্থনীতির গতি বাড়ে। কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু নতুন ঋণ নিয়ে যদি তা পুরনো ঋণ শোধ করতেই খরচ হয়, তা হলে ভবিষ্যতের জন্য বোঝা বাড়ে। নতুন কোনও সম্পদও তৈরি হয় না। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজ্য সরকারের অর্থ দফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘বাম সরকারের রেখে যাওয়া দেনার বোঝার ফলেই পশ্চিমবঙ্গের রাজকোষের এই অবস্থা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তার মোকাবিলা করারচেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের প্রাপ্য অর্থ বকেয়া রেখে দিয়ে সমস্যা আরও বাড়িয়েছে।’’