ভারতে প্রকৃত বৃদ্ধির হার নাগাড়ে কমছে ২০১৬ থেকে। ছবি: সংগৃহীত।
কোভিড ছোবল বসিয়েছে ঠিকই। কিন্তু আসলে অতিমারির আক্রমণের আগে থেকেই যে অর্থনীতির দশা বেহাল ছিল, ফের তার ‘জলজ্যান্ত প্রমাণ’ পেশ করল সরকারি পরিসংখ্যান। শুক্রবার তাদের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কোভিড আর লকডাউনের জোড়া ধাক্কার আগেই ২০১৯-২০ সালে বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ!
সে না-হয় অতীত। কিন্তু আগামী দিনের জন্যও মোদী সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে এ দিন আর্থিক সমীক্ষায় পূর্বাভাস, চলতি অর্থবর্ষে জিডিপি সঙ্কুচিত হবে ৭.৭%। এতখানি কমে যাওয়া জিডিপি-র ভিত্তিতে হিসেব হওয়ায় পরের বছরে (২০২১-২২) বৃদ্ধি পৌঁছবে ১১ শতাংশে। মূল্যবৃদ্ধি-সহ বৃদ্ধির হার ১৫.৪%।
বৃদ্ধির ওই ‘চড়া’ হারকে সামনে রেখে অর্থনীতির হাল ফেরানোর প্রচারে নামতে আগ্রহী সরকারের একাংশ। কিন্তু বাস্তব থেকে যে তা কত দূরে, দু’টি হিসেবেই তা স্পষ্ট:— প্রথমত, চলতি অর্থবর্ষে ৭.৭% সঙ্কোচনের দরুন জিডিপি ১৩৪.৪ লক্ষ কোটি টাকায় নেমে যাবে। সমীক্ষার পূর্বাভাস মিলিয়ে আগামী বছরে তা ১১% বেড়ে সত্যিই ১৪৫.৭ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছলেও, কোভিডের আগের (২০১৯-২০) জিডিপির তুলনায় তা হবে মাত্র ২.৪% বেশি। অর্থাৎ, ১১ শতাংশের দৌলতে দ্রুততম বৃদ্ধির দেশের তকমা ফেরত পাওয়ার ঢক্কা-নিনাদই সার।
দ্বিতীয়ত, সমীক্ষাই বলছে, প্রাক-কোভিড দশায় ফিরতেই অর্থনীতির দু’বছর লাগবে। সে ক্ষেত্রে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগেও অর্থনীতির ছবি তেমন উজ্জ্বল হবে না।
প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু আগেই দেখিয়েছেন, ভারতে প্রকৃত বৃদ্ধির হার নাগাড়ে কমছে ২০১৬ থেকে। সমীক্ষায় ইঙ্গিত, আগামী দিনও সুখের নয়। মনমোহন সিংহের জমানায় প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী দাবি করতেন, দুর্নীতি আর নীতিপঙ্গুত্বের কারণেই ৮-৯ শতাংশ বৃদ্ধির গতিতে দৌড়তে পারছে না ভারতীয় অর্থনীতি। বিরোধীদের কটাক্ষ, এখন তাঁর নিজের আমলে কোভিড পূর্ববর্তী জায়গায় ফিরতেই ৩ শতাংশের কম বৃদ্ধির গতিতে হামাগুড়ি দিতে হচ্ছে অর্থনীতিকে।
এক ঝলকে
সমীক্ষা অনুযায়ী, চলতি অর্থবর্ষে সঙ্কোচন আরও বেশি হত, যদি না কিছুটা মুখ বাঁচাত কৃষি। চলতি বছরে একমাত্র সেখানেই ৩.৪% বৃদ্ধির পূর্বাভাস। শিল্প এবং পরিষেবায় সঙ্কোচনের হার সমগ্র অর্থনীতির থেকেও অনেক বেশি।
সংসদে সমীক্ষা পেশের পরে মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মণ্যম সওয়াল করেছেন, কড়া লকডাউন জরুরি ছিল। তার জন্যই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর হার কম রাখা গিয়েছে। দাবি, সেই কারণেই অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারছে।
অথচ দেশের অর্থনীতিতে আগেই ঝিমুনির লক্ষণ স্পষ্ট। ২০১৯-২০ সালে বৃদ্ধি ৪.২ শতাংশে নেমেছে বলে জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর জানিয়েছিল। আজ হিসেব শুধরে তা আরও নামিয়ে করা হয়েছে ৪%। সমীক্ষা বলেছে, কোভিডের আগের অবস্থাকে মাপকাঠি ধরলে, ওই টেনেটুনে ৪% বৃদ্ধিতে পৌঁছতেও লোকসভা ভোট এসে যাবে!
আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের মুখ্য অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ আগেই বলেছিলেন, ভারতের অর্থনীতিকে প্রাক-কোভিড অবস্থায় পৌঁছতে ২০২৫ সাল পেরিয়ে যাবে। সমীক্ষায় কার্যত তারই প্রতিফলন।
বিরোধীরা বলছেন, আসল ছবি এমন বিবর্ণ হওয়ায়, দ্রুততম বৃদ্ধির দেশের তকমাও টিকবে শুধু পরের বছর। তার পরে দেখা যাবে, বৃদ্ধির হার ৩-৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সমীক্ষাতেও এমন অনুমান করেই যাবতীয় অঙ্ক কষা হয়েছে।
কিন্তু বৃদ্ধির হার এত কম হলে, জিডিপির তুলনায় রাজকোষ ঘাটতি কিংবা দেনার হার কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের দুশ্চিন্তা যথেষ্ট। কিন্তু মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা এ দিন অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন, ২০২২ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি মোটে ৩.৮% থাকলেও, কমবে দেনার বোঝা।