শ্বেতমর্মরের সৌধটি স্থাপত্যের গুণেই চোখে পড়ে দূর থেকে। ইনদৌর শহরের দক্ষিণে ব্রিটিশ জমানার সেনা ছাউনি মহূ। তার মধ্যেই রয়েছে সংবিধানপ্রণেতা ভীমরাও অম্বেডকরের এই সৌধ। দেখলেই ঠাওর করা যায়, সেনা তত্ত্বাবধানে থাকায় পরিচর্যার অভাব হয়নি। যদিও অম্বেডকরের মৃত্যুর দুই যুগ কেটে যাওয়ার পরে কাল থেকে যেন নতুন করে শুরু হচ্ছে তাঁর ঐতিহ্য দখলের রাজনৈতিক লড়াই। অবশ্যই তাঁর দর্শন পরিচর্যা তথা অনুসরণের মোড়কে।
অম্বেডকরের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনে খুবই যত্নশীল এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ ব্যাপারে ১৬ দফা কর্মসূচি নিয়েছে তাঁর সরকার। এমনকী, ১৯৭ কোটি টাকা খরচ করে মহূ-র এই সৌধের চেয়ে শতগুণে বড় একটি আন্তর্জাতিক অম্বেডকর কেন্দ্র গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার! এ-ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, ৯৯ কোটি টাকা খরচ করে নয়াদিল্লিতে বাবাসাহেবের সুউচ্চ একটি মূর্তিও গড়বে মোদী সরকার!
ব্যাপারটা অবশ্য একতরফা নয়। কংগ্রেসও পিছিয়ে নেই অম্বেডকরের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনে। মহূ অম্বেডকরের জন্মস্থান। কাল এখানেই তাঁর মূর্তিতে মালা দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে অম্বেডকরের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন শুরু করবেন রাহুল গাঁধী। এর পর দুপুরে কোনও দলিতের বাড়িতে সারবেন দপুরের খাওয়া। বিকেলে জনসভা। তার পর দলিতদের সঙ্গে একান্তে আলোচনা তথা ‘চৌপাল’ করবেন কংগ্রেস সহসভাপতি। এবং রাহুলের এই দলিতবান্ধব কর্মসূচির ঠিক আগের দিনই কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী দেশের নানা প্রান্তে দলিতদের উপরে অত্যাচার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তাতে সনিয়ার অভিযোগ, দলিতদের উপরে অত্যাচার রোধে ২০১৪ সালে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার একটি অধ্যাদেশ এনেছিল। পরে তা সংসদীয় কমিটিতে যায়। গত ডিসেম্বরে কমিটি তার সুপারিশ জানিয়ে দিয়েছে। মোদী অধ্যাদেশটি সংসদে পাশ করাতে আদৌ উদ্যোগী হননি। বাতিল হয়ে গিয়েছে অধ্যাদেশটি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, অম্বেডকর স্মরণ ও দলিতদের নিয়ে এত তৎপরতার পিছনে রয়েছে স্পষ্ট একটি রাজনেতিক লক্ষ্য। দুই শিবিরই চাইছে দেশের ১৬ শতাংশ দলিত ভোট যথাসম্ভব নিজেদের দখলে আনতে। প্রকাশ্যে মেনে নিতে কুন্ঠা থাকলেও কংগ্রেসের অনেক বর্ষীয়ান নেতা মনে করেন, নেহরু-গাঁধীর ঐতিহ্যকে অতিমাত্রায় আঁকড়ে থেকে কংগ্রেস অম্বেডকরের ঐতিহ্যকে বেমালুম ভুলতে বসেছিল। তাতে কংগ্রেস সম্পর্কে ভুল বার্তা গিয়েছে দলিতদের কাছে। ফলে যে জনভিত্তি এক সময় কংগ্রেসের পুঁজি ছিল, সেই দলিত ভোটব্যাঙ্ক তাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। বাবাসাহেবের দিকে ফিরে দেখাটাই হয়তো মোড় ঘোরাতে পারে পরিস্থিতির।
বিজেপির সমস্যাটা অন্য। দলের এক আরএসএস-ঘনিষ্ঠ নেতার মতে, উচ্চবর্ণের হিন্দু দল হিসেবে ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে গিয়েছে বিজেপির। অতীতে বঙ্গারু লক্ষ্মণের মতো দলিত নেতাকে দলের সভাপতি করেও সেই ধারণার বদল ঘটানো যায়নি। তা হলে জনভিত্তি বাড়বে কী ভাবে? এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই দলিত হিন্দুদের মধ্যে প্রভাব বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবার। মূলত সঙ্ঘের চাপেই অম্বেডকরের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনে ঝাঁপিয়েছে মোদী সরকার।
তবে রাহুল গাঁধীর ঘনিষ্ট এক তরুণ নেতা বলেন, কংগ্রেস সহসভাপতি বরাবরই দলিতদের কাছে পৌঁছতে আগ্রহী। দলিতের বাড়িতে তিনি রাত্রিবাসও করেছেন। কিন্তু তা কেবল প্রতীকী হয়েই থেকে গিয়েছে। সুনির্দিষ্ট ও ধারবাহিক দলীয় কর্মসূচিতে রূপান্তরিত হয়নি তা। কিন্তু অম্বেডকরের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের মাধ্যমে দলিত ক্ষমতায়নকে এ বার আন্দোলনের স্তরে নিয়ে যেতে চাইছেন রাহুল। আর সে কাজের জন্য এক জন কারিগরও বেছে নিয়েছেন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার কে রাজু। সরকারি আমলা হিসেবেই সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্ব জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদে কাজ করেছেন এই দলিত ভদ্রলোক। পরে চাকরি ছেড়ে সরাসরি কংগ্রেসে যোগ দেন। রাজু আজ বলেন, ‘‘দলিতদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দাবিকে আন্দোলনের স্তরে নিয়ে যাওয়াই রাহুলের উদ্দেশ্য। আগামী এক বছরে দেশের সব দলিত অধুষ্যিত এলাকায় তিনি সফর করবেন।’’
ঘরোয়া আলোচনায় রাজু এ-ও দাবি করেন, মহূ-তে কালকের সভাকে রাহুলের ‘বেলচি’ মুহূর্ত করে তোলাটাই পাখির চোখ তাঁর। বেলচি? ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিহারের বেলচি গ্রামে দলিতদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। সেটাই ছিল তাঁর ক্ষমতায় ফেরার যাত্রা শুরু।
যদিও কংগ্রেসেরই অনেকে মনে করছেন, সেই জমানা গিয়েছে। দলিতদের ফের কাছে টানার লড়াইটা অত সহজ নয়। একে তো মায়াবতীর মতো নেত্রী ও তাঁর আঞ্চলিক দল বহুজন সমাজ পার্টি সেই ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়ে রেখেছে প্রয়াত কাঁসিরামের আমল থেকে। তার উপরে পাল্লা দিতে হবে বিজেপি ও সঙ্ঘের সংগঠিত কর্মসূচির সঙ্গে। পরিকল্পিত ভাবে হিন্দিবলয় ও তার বাইরে দলিতদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে সঙ্ঘ-বিজেপি। সামাজিক ভেদাভেদ ঘোচাতে তারা স্লোগান তুলছে ‘‘এক মন্দির, এক কুঁয়া, এক শ্মশান।’’
রাজুর অবশ্য দাবি, ‘‘দলিতরা এখন আর শুধু এক থালায় বসে ভাত খেয়েই খুশি থাকতে চায় না। তাঁরা চায় উন্নয়নের শরিক হতে। ভুলে গেলে চলবে না, দলিত ক্ষমতায়নের জন্য যাবতীয় আইন কংগ্রেস জমানাতেই প্রণয়ন করা হয়েছিল।’’ এবং মোদী যে এ ব্যাপারে আদৌ আন্তরিক নন, সেটাই আজ চিঠির মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছেন সনিয়া। মায়ের এই ব্যাটনটাই হাতে নিয়ে কাল মোদীকে নিশানা করবেন রাহুল। একটা দৌড় যেন মা-ছেলের জুটি ও মোদীর।
কে আগে ছোঁবে দলিতদের!