নিজে রাজকুমারী। স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছিলেন এমন এক রাজপুরুষকে, যাঁর অন্দরমহলে তখন দু’জন মহিষী বিরাজ করছেন। তার পরেও তিনিই হয়েছিলেন রাজমহিষী। ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য ও আধুনিকতার সন্ধিতে অনবদ্য, জয়পুরের প্রাক্তন মহারানি, গায়ত্রী দেবী।
কোচবিহারের রাজবংশে ১৯১৯ সালের ২৩ মে জন্ম গায়ত্রী দেবীর। তাঁর বাবা জিতেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন কোচবিহারের মহারাজা। মা, ইন্দিরা রাজে ছিলেন ভডোদরার মরাঠা রাজকুমারি। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর। ঠাকুমা, কোচবিহারের মহারানি সুনীতিদেবী ছিলেন ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ে।
গায়ত্রী দেবীর পড়াশোনা শুরু লন্ডনের প্রিপারেটরি স্কুলে। তারপর বিশ্বভারতীর পাঠভবন এবং পরে উচ্চশিক্ষা সুইৎজারল্যান্ডে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ঘোড়সওয়ার এবং পোলো খেলোয়াড়। ভালবাসতেন শিকার করতে এবং নিত্যনতুন গাড়ি চালাতে।
পোলো খেলতেই মাত্র ১২ বছর বয়সে এসেছিলেন কলকাতায়। তখনই আলাপ জয়পুরের তৎকালীন রাজা দ্বিতীয় সোয়াই মান সিংহের সঙ্গে। পরে, ১৯৪০ সালে তাঁকেই বিয়ে করেন ২১ বছর বয়সী গায়ত্রী দেবী। দু’জনের বয়সের ব্যবধান সাত বছর।
গায়ত্রী দেবীর দিদিমা এবং মা দু’জনেই ছিলেন সময়ের তুলনায় এগিয়ে। তাঁদের থেকে সেই ধারা পেয়েছিলেন গায়ত্রী দেবী নিজেও। দুই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েও নিজের প্রেমের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন তিনি। বাবা মায়ের অসম্মতি সত্ত্বেও বিয়ে করেছিলেন রাজা দ্বিতীয় সোয়াই মান সিংহকে।
দ্বিতীয় সোয়াই মান সিংহের প্রথম পক্ষের দুই রানি ছিলেন যোধপুরের রাজকন্যা। তবে তাঁর বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন গায়ত্রী দেবীই। রাজ অন্তঃপুরে কর্তৃত্বের পাশাপাশি তিনিই হয়ে ওঠেন জয়পুরে রাজমাতা। ১৯৪৯ সালে জন্ম হয় তাঁর একমাত্র সন্তান, জগৎ সিংহের।
তবে রাজপরিবারে পর্দাপ্রথা মানতে রাজি ছিলেন না গায়ত্রী দেবী। অন্য দুই রাজমহিষী পর্দানসীন থাকলেও গায়ত্রীদেবী জীবন কাটিয়েছিলেন নিজের মতোই। তাঁকে কোনও বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলা যায়নি।
স্বাধীন ভারতে রাজনীতির অন্যতম নাম ছিলেন গায়ত্রী দেবী। শান্তিনিকেতনে ছাত্রীজীবন থেকে ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে তাঁর যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছিল, তা বজায় ছিল পরবর্তী কালেও রাজনীতির ময়দানেও।
চক্রবর্তী রাজা রাজাগোপালাচারীর স্বতন্ত্র পার্টির প্রার্থীর হয়ে গায়ত্রীদেবী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ১৯৬২ সালের লোকসভা নির্বাচনে। জয়ী হয়েছিলেন রেকর্ড ব্যবধানে। ১৯৬৭ এবং ১৯৭১-এর লোকসভা নির্বাচনেও তিনি কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয় ধরে রাখতে পেরেছিলেন।
সাতের দশকে জরুরি অবস্থার সময়ে আয়কর আইন অবমাননার দায়ে তাঁকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। পাঁচ মাস তিনি বন্দিজীবন কাটিয়েছিলেন তিহাড় জেলে। এরপর ধীরে ধীরে রাজনীতির ময়দান থেকে সরে আসেন তিনি।
রাজপরিবারের তথাকথিত সনাতনী রীতি রেওয়াজের বিরুদ্ধে থাকলেও তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। স্বাধীন ভারতে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পরেও তিনিই ছিলেন জয়পুরের ‘রাজমাতা’।
২০০৯-এর ২৯ জুলাই ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হন গায়ত্রী দেবী। ভারতীয় ঐতিহ্যের অলিন্দে তাঁর নাম এখনও একটি প্রতিষ্ঠানস্বরূপ।