Haryana Assembly Election 2024

হরিয়ানায় কংগ্রেসের আশা ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন কেজরী, দিল্লির বিধানসভা ভোটের আগে ‘চাপে’ আপ

হরিয়ানায় এ বারের বিধানসভা ভোটে আসন সংখ্যায় বিজেপির তুলনায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ভোট শতাংশের হিসাবে কংগ্রেস প্রায় কাছাকাছি। ব্যবধান ১ শতাংশেরও কম।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪ ১৯:২২
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

হরিয়ানায় কংগ্রেসের আশায় জল ঢেলে দিলেন আম আদমি পার্টি (আপ) প্রধান অরবিন্দ কেজরীওয়াল। বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে কার্যত নিশ্চিত করলেন সে রাজ্যে টানা তিন বার বিজেপির ক্ষমতায় আসা। মঙ্গলবার ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমনই কথা বলছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।

Advertisement

৯০ আসনের হরিয়ানায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ৪৬। ফল বলছে, এক দশক পরে আবার সেই লক্ষ্য ছুঁতে চলেছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল। ২০১৪ সালে ৪৭টি আসনে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা ক্ষমতা দখল করলেও ২০১৯-এ বিজেপির আসন ৪০-এ নেমে গিয়েছিল। সরকার গড়তে আইএনএলডি-ছুট দুষ্মন্ত চৌটালার দল জননায়ক জনতা পার্টি (জেজেপি)-র উপর নির্ভর করতে হয়েছিল তাদের।

ভোট শতাংশের হিসাব বলছে, বহু আসনে নোটার চেয়ে কম ভোট পেলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে নিজের ‘নাক কেটে’ কংগ্রেসের ‘যাত্রাভঙ্গ’ করেছে আপ। তা ছাড়া, লোকসভা ভোটের পাঁচ মাসের মধ্যেই ‘ইন্ডিয়া’য় ফাটল ভোটারদের একাংশকে প্রভাবিত করেছে বলেও বিরোধীদের অনেকে মনে করছে। বিধানসভা ভোটে দু’দলের জোট হলে বিজেপির জয় সহজ হত না বলেই তাঁদের ধারণা। এ ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে কংগ্রেসের চেয়েও আপের উপর ‘চাপ’ বেশি। কারণ, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা। সেখানে ২০১৩ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় রয়েছে আপ। এ বারের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেও দিল্লির সাতটি আসনে বিজেপির জয় ঠেকাতে পারেননি কেজরী। আবগারি মামলায় গ্রেফতারির পরে ছ’মাস তিহাড় জেলে কাটিয়ে হরিয়ানায় প্রচারে নেমেছিলেন আপ প্রধান। কিন্তু দলের বিপর্যয় ঠেকাতে পারেননি। ঘটনাচক্রে, হরিয়ানার পড়শি রাজ্য পঞ্জাবে সরকার চালাচ্ছে আপ। দুই রাজ্যের যৌথ রাজধানী চণ্ডীগড়ে কংগ্রেসের সমর্থনেই কেজরীর দলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।

Advertisement

কী কী অঙ্কে বিজেপির জয়

টানা এক দশক ক্ষমতায় থাকার পরেও ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া’ অতিক্রম করে হরিয়ানায় আবার নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছে বিজেপি। কৃষক আন্দোলনের আঁচ, বিনেশ ফোগাটের ‘বঞ্চনা’, বিজেপি নেতা ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে হরিয়ানার কয়েক জন মহিলা কুস্তিগিরের তোলা যৌন নিগ্রহের অভিযোগ, চুক্তিভিত্তিক সেনা নিয়োগের ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প ঘিরে ক্ষোভের ছায়া পড়েনি হরিয়ানার বিধানসভা ভোটের ফলে। এর পিছনে পদ্মশিবিরের নিপুণ ‘বুথ লেভেল ম্যানেজমেন্ট’-এর পাশাপাশি জাতপাতের অঙ্কেরও বড় ভূমিকা রয়েছে বলে ভোটপণ্ডিতদের একাংশ মনে করছেন। তাঁদের বিশ্লেষণ বলছে, উত্তর ও মধ্য হরিয়ানার জাঠ প্রভাবিত অঞ্চলে কংগ্রেস ভাল ফল করলেও দক্ষিণে অ-জাঠ অঞ্চলে বড় জয় পেয়েছে বিজেপি। ভাল ফল করেছে রাজ্যের পশ্চিম অংশেও।

পরিসংখ্যান বলছে, হরিয়ানায় জাঠ ভোট প্রায় ২৭ শতাংশ, দলিত (এসসি) ২১ শতাংশ, অন্যান্য অনগ্রসর (ওবিসি) প্রায় ৩৩ শতাংশ। জাঠ ভোট কংগ্রেস, আইএনএলডি, জেজেপির মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। ‘উচ্চবর্ণ’ এবং ওবিসি ভোটের অধিকাংশই পেয়েছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী নয়াব সিংহ সাইনি ওবিসি জনগোষ্ঠীর হওয়ায় বিজেপি সুবিধা পেয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কংগ্রেসের জাঠ নেতা ভূপেন্দ্র সিংহ হুডার সঙ্গে মতবিরোধের কারণে দলিত নেত্রী কুমারী শৈলজা প্রচার পর্ব থেকে দূরে সরে থাকারও সুফল পেয়েছে তারা। এমনকি, ‘জাঠ প্রভাবিত’ বলে চিহ্নিত কয়েকটি আসনেও বিজেপির পক্ষে অ-জাঠ ভোটের একত্রীকরণ দেখা গিয়েছে এ বারের বিধানসভা ভোটে! তা ছাড়া, নুহ্র সাম্প্রতিক গোষ্ঠীহিংসাও বিজেপির পক্ষে মেরুকরণ ঘটিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

হারলেও ভোট বেড়েছে কংগ্রেসের

টানা তিন বার ভোটে হারলেও কংগ্রেসের ভোট এবং আসন দু’টিই বেড়েছে হরিয়ানায়। ২০০৪ থেকে টানা এক দশক ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস ২০১৪-য় হরিয়ানার ভোট এবং আসনসংখ্যার হিসাবে তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছিল। সাড়ে ২০ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিল মাত্র ১৫ আসনে। ২৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯ আসনে জিতে দ্বিতীয় হয়েছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালার আইএনএলডি। ২০১৯ সালের বিধানসভা ভোটে ২৮ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে ৩১টি আসনে জিতে দ্বিতীয় হয়েছিল কংগ্রেস। এ বার আসনসংখ্যায় বিজেপির তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও ভোট শতাংশের হিসাবে কংগ্রেস প্রায় তুল্যমূল্য। সে রাজ্যে রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খড়্গের দলের ঝুলিতে গিয়েছে প্রায় ৩৯.১ শতাংশ ভোট। বিজেপি প্রায় ৩৯.৯ শতাংশ। অর্থাৎ, দু’দলের ব্যবধান এক শতাংশেরও কম। অন্য দিকে আপ পৌনে ২ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে।

ঘটনাচক্রে, এ বার হরিয়ানায় বিধানসভা ভোটের প্রচার পর্বে পালাবদলের ইঙ্গিত ছিল। অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষাতেও বিজেপির তুলনায় কংগ্রেসকে এগিয়ে রাখা হচ্ছিল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী মোদী হরিয়ানায় বিধানসভা ভোটে এক ডজনের বেশি জনসভা করলেও এ বার মাত্র চারটি প্রচার কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। গত বছর তেলঙ্গানায় বিধানসভা ভোটের প্রচারেও এ ভাবেই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন মোদী। দক্ষিণের ওই রাজ্যে কংগ্রেস বিপুল জয় পেয়েছিল। হরিয়ানায় তার পুনরাবৃত্তির আশা করেছিলেন রাহুল-খড়্গেরা। কিন্তু তা মিলল না।

হরিয়ানার ভোটে বাংলার ছায়া

এ বারের হরিয়ানার ভোটের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা ভোটের ফলের তুলনা টানছেন অনেকেই। বাংলায় কংগ্রেস এবং তৃণমূলের জোট হলে রাহুলের দলের সাংসদ সংখ্যা এক থেকে বেড়ে দুই হত (কারণ, তৃণমূলের তরফে ভোটের আগেই কংগ্রেসকে ২০১৯-এ জেতা মালদহ দক্ষিণ এবং বহরমপুর ছাড়ার বার্তা দেওয়া হয়েছিল)। অন্য দিকে, দুই দলের জোট হলে মালদহ উত্তর, রায়গঞ্জ, পুরুলিয়ার মতো লোকসভা আসনে জেতা কঠিন হত বিজেপির। অবশ্য, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ বলছেন, বাংলায় কংগ্রেস-তৃণমূলের মতোই হরিয়ানায় কংগ্রেস-আপ সমীকরণও আদতে ‘ব্যাস্তানুপাতিক’। অর্থাৎ, আপের বাড়বৃদ্ধি হবে কংগ্রেসের ক্ষতিবৃদ্ধি হলে। আবার একই রকম ভাবে কংগ্রেসের উন্নতি হবে আপের অবনতিতে।

গুরুত্বপূর্ণ জয় এবং পরাজয়

বিজেপি উল্লেখযোগ্য প্রার্থীদের বড় অংশই বিধানসভা ভোটে জিতেছন এ বার। মুখ্যমন্ত্রী নয়াব সিংহ সাইনি (লডওয়া), প্রভাবশালী মন্ত্রী অনিল ভিজ (অম্বালা ক্যান্টনমেন্ট), প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বংশীলালের নাতনি তথা প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ শ্রুতি চৌধরি (তোশাম), প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভজনলালের নাতি তথা প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা কুলদীপ বিশনইয়ের পুত্র ভব্য (আদমপুর), মডেল জেসিকা লালের খুনি মনু শর্মার মা শক্তিরানি (কালকা), কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাও ইন্দ্রজিৎ সিংহের কন্যা আরতি (অটেলি) রয়েছেন এই তালিকায়।

কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা রোহতক জেলার গরহি সাম্পলা-কিলোই আসনে জিতেছেন। জিতেছেন কুস্তিগির বিনেশ ফোগাট (জুলানা)। পঞ্চকুলায় বিদায়ী বিধানসভার স্পিকার, বিজেপির জ্ঞানচাঁদ গুপ্তকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রমোহন (প্রয়াত ভজনলালের আর এক পুত্র)। প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী তথা এআইসিসির মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার পুত্র আদিত্যও (কৈথল) রয়েছেন জয়ীদের তালিকায়। তবে বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী ক্যাপ্টেন অভিমন্যু, কংগ্রেস প্রার্থী প্রাক্তন মন্ত্রী তথা হুডার আত্মীয় করণ দালালের মতো ‘হেভিওয়েট’রা রয়েছেন পরাজিতের তালিকায়।

কুরুক্ষেত্রের বিজেপি সাংসদ তথা জিন্দল শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার নবীন জিন্দলের মা সাবিত্রী নির্দল হিসাবে দাঁড়িয়ে হারিয়ে দিয়েছেন বিজেপিকে। প্রয়াত প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী দেবীলালের দুই প্রপৌত্র অর্জুন সিংহ চৌটালা এবং আদিত্য দেবীলাল যথাক্রমে রানিয়া এবং ডাবওয়ালী আসনে আইএনএলডি প্রার্থী হিসাবে জিতেছেন। তবে তাঁর অন্য দুই প্রপৌত্র, প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী দুষ্মন্ত (উচানা কালান) এবং দিগ্বিজয় (ডাবওয়ালি) হেরেছেন। তবে ‘পারিবারিক আসন’ এলানাবাদে হেরে গিয়েছেন দেবীলালের পৌত্র তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশের পুত্র অভয় চৌটালা।

হরিয়ানায় বিজেপি উত্থান কোন পথে?

এক দশক আগেও হরিয়ানায় তৃতীয় বা চতুর্থ ‘শক্তি’ হিসাবেই বিবেচিত হত বিজেপি। কখনও দেবীলাল-ওমপ্রকাশ চৌটালার আইএনএলডি, কখনও বংশীলালের হরিয়ানা বিকাশ পার্টির ছোট শরিক হয়ে কয়েকটি মন্ত্রীপদ পেলেও অটলবিহারী বাজপেয়ী-লালকৃষ্ণ আডবাণীদের জমানায় কখনও উল্লেখ্যযোগ্য শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি তারা। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর উত্থানের পরেই পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে রাজ্যের ১০টি লোকসভা আসনের মধ্যে আটটি আসনে লড়ে সাতটিতে জিতেছিল তারা। সে বছরের অক্টোবরের বিধানসভা ভোটে এক দশকের কংগ্রেস শাসনের ইতি টেনে প্রথম বার হরিয়ানায় ক্ষমতা দখল করেছিল পদ্মশিবির। ৩৩ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে ৯০ আসনের মধ্যে ৪৭টিতে জিতেছিল।

এর পর ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ‘মোদী ঝড়ে’ ভর করে ১০টি আসনেই জিতেছিল বিজেপি। পেয়েছিল ৫৮ শতাংশ। কিন্তু সে বছরের অক্টোবরের বিধানসভা ভোটে ধাক্কা খায় তারা। ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় জেতে ৪০টি আসনে। শতাংশের হিসাবে বিজেপি প্রায় সাড়ে ৩৬ শতাংশ, কংগ্রেস প্রায় ২৯ শতাংশ এবং জেজেপি সাড়ে ১৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। প্রাক্তন শাসকদল আইএনএলডির ভোট আড়াই শতাংশেরও নীচে নেমে গিয়েছিল ২০১৯-এর বিধানসভা ভোটে। এর পরে জেজেপির ১০ বিধায়কের সমর্থনে ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মনোহরলাল খট্টর।

কিন্তু চলতি বছরে লোকসভা ভোটের আগে সে জোট ভেঙে যায়। গত মার্চে খট্টরকে সরিয়ে নয়াব সিংহ সাইনিকে মুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। এ বারের লোকসভা ভোটে কংগ্রেস এবং বিজেপি দু’দলই হরিয়ানায় পাঁচটি করে আসনে জিতেছিল। লোকসভায় আপ এবং কংগ্রেস আসন সমঝোতা করলেও এ বার দু’দল আলাদা ভাবে লড়েছে। লোকসভা ভোটের হিসাবে বিজেপি ৪৬ শতাংশ এবং কংগ্রেস ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অর্থাৎ, মাত্র দু’শতাংশের ফারাক ছিল দু’দলে। এ বার আপের সাহায্য ছাড়াই সেই ব্যবধান আরও কমিয়ে আনল কংগ্রেস। তবে ঠেকাতে পারল না বিজেপির জয়ের হ্যাটট্রিক। যার নেপথ্যে ভূমিকা রইল কেজরীর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement