ফাইল চিত্র।
জাতীয় রাজনীতিতে দল হিসাবে বিজেপি যত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, ততই দুর্বল হচ্ছে এনডিএ। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে একে একে পিডিপি, শিবসেনা, শিরোমণি অকালি দলের পরে এ বার এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে জেডিইউ। শরিক হিসেবে বড় দল বলতে রয়ে গিয়েছে তামিলনাড়ুর এডিএমকে, মহারাষ্ট্রে একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ শিবসেনা ও উত্তরপ্রদেশের আপনা দল (সোনেলাল)। রাজনীতির অনেকের মতে, বিজেপি গোটা দেশে জিতছে বলে এখন সমস্যা নেই। কিন্তু দল যদি দুর্বল হয়, তখন ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে বিজেপিকে সংখ্যা জোগানোর কেউ থাকবে না। পাল্টা যুক্তিতে বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, দল একক ভাবে সরকার গড়ার মতো জায়গায় থাকায় স্বাভাবিক কারণেই শরিক নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে।
অটলবিহারী জমানায় শরিক দলগুলিকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হলেও, অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি একার জোরে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই শরিক দলগুলির অবমাননা শুরু হয়। মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক না পাওয়া, শরিক দলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে একতরফা আইন পাশ, শরিকদের যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে এনডিএ। এর মধ্যে ২০১৮ সালে কাশ্মীরে পিডিপি-র সঙ্গে একতরফা সম্পর্ক ছেদ করার সিদ্ধান্তে এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসে মেহবুবা মুফতির দল। পরবর্তী সময়ে মহারাষ্ট্রে সরকার গড়া নিয়ে শিবসেনার সঙ্গে তিক্ততার কারণে সম্পর্ক ছেদ হয় দুই শিবিরের।
অন্য দিকে বিতর্কিত কৃষি বিলের বিরুদ্ধে সরব হয়ে সরকার ছেড়ে বেরিয়ে যান অকালিরা। আর মহারাষ্ট্রের ধাঁচে বিজেপি বিহারে জেডিইউকে ভাঙার চেষ্টা করছে, ওই অভিযোগে এনডিএ ছেড়ে গতকাল বেরিয়ে যান নীতীশ কুমার। বিজেপি নেতা সুশীল মোদী অবশ্য বলেন, বলেন, ‘‘নীতীশজির সঙ্গে আমাদের ১৭ বছরের সম্পর্ক। আমরা শরিক দল ভাঙাতে যাব কেন? জেডিইউ ভাঙিয়েও তো বিজেপি বিহারের সরকার গড়তে পারত না। কারণ সেই সংখ্যাই তো নেই বিজেপির কাছে! মনে রাখবেন, বিজেপি কাউকে ধোঁকা দেয় না।’’
২০১৯ সালের পরে এনডিএ থেকে বেরিয়ে এসেছে ছোট দলগুলিও। গত তিন বছরে এনডিএ ছেড়েছেন রাজ্যের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, গোয়া ফরোয়ার্ড পার্টি ও রাজস্থানের রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি। অসমে ২০২১ সালে অসম গণ পরিষদ দলের সাহায্য ছাড়া বিজেপির সে রাজ্য দখল কার্যত সম্ভব ছিল না। কিন্তু অভিযোগ, জেতার পরেই ওই রাজ্যে কার্যত অগপ-কে ধারাবাহিক ভাবে দুর্বল করে চলেছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মার নেতৃত্বাধীন বিজেপি।
রাজনীতির অনেকের মতে, জোট শরিকদের ধরে রাখতে গেলে যে সম্মান দেওয়া প্রয়োজন, তা ভুলে গিয়েছেন এখনকার বিজেপি নেতারা। নীতীশের কথায়, ‘‘বাজপেয়ী জমানায় যে এনডিএ ছিল, তাতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কনভেনর ছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ। জোট শরিকদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা হত। আর এখন আমরা যাঁদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করে পাঠিয়েছি বিজেপি তাঁকেই নিজেদের দলে টেনে নিয়েছে।’’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বাজপেয়ী জমানায় দল হিসাবে বিজেপি ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল। সরকার ধরে রাখতে গেলে শরিকদের সমর্থন প্রয়োজন ছিল বাজপেয়ী-আডবাণীদের। তাই শরিকদের অনেক অন্যায্য দাবি মেনে নিতে বাধ্য হতেন বিজেপি নেতারা। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে ছবিটি পাল্টে যায়। শেষ দু’টি লোকসভা নির্বাচনে একক ক্ষমতায় সরকার গড়ার জায়গায় পৌঁছতে পেরেছিল বিজেপি। ফলে স্বভাবতই বিজেপির শরিক নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে।
তা ছাড়া, বিজেপি নীতিগত ভাবে মনে করে, আঞ্চলিক দলগুলির নীতি দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। বিজেপি সভাপতি জেপি নড্ডা সম্প্রতি একটি আলোচনা সভায় বলেন, অধিকাংশ আঞ্চলিক দল পরিবারতান্ত্রিক। তার জন্য জাতপাত ও ধর্মভিত্তিক তোষণের রাজনীতিতেও পিছপা হয় না আঞ্চলিক দলগুলি। এতে সামগ্রিক ভাবে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আঞ্চলিক দলগুলির পরিবর্তে প্রতিটি রাজ্যে বিজেপিকে শক্তিশালী করার ডাক দেন তিনি। সেই নীতির প্রভাব পড়েছে বিজেপির সঙ্গে এনডিএর শরিকদের সম্পর্করক্ষার ক্ষেত্রেও।