ফাইল ছবি
কেন্দ্রের অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ দেশ। এখনও পর্যন্ত ওই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ নিয়ে সরাসরি একটি শব্দও খরচ করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বেঙ্গালুরুতে আজ এক অনুষ্ঠানে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত প্রাথমিক ভাবে খারাপ মনে হলেও, ভবিষ্যতে তাতে লাভই হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশের মতে, প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষে যুবসমাজকে অগ্নিপথ প্রকল্পের ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
যদিও বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের আশঙ্কা, যে ভাবে ওই প্রকল্পের বিরোধিতা শুরু হয়েছে, তাতে কৃষি আইনের মতো অগ্নিপথ প্রকল্পও প্রত্যাহারের রাস্তায় হাঁটতে হতে পারে সরকারকে। শাসক শিবিরের রক্তচাপ বাড়িয়ে বিরোধীদের সুরেই ওই প্রকল্পের বিরোধিতায় সরব জোটসঙ্গী নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ-ও। এমতাবস্থায়, পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আগামিকাল তিন সেনা প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরোধিতায় যে ভাবে যুবসমাজ পথে নেমেছে তাতে কপালে ভাঁজ পড়ছে পদ্ম শিবিরের নেতাদের। দেশ জুড়ে অগ্নিপথ প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বেঙ্গালুরুতে আজই মোদী বলেন, ‘‘সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত প্রথমে খারাপ লাগলেও, পরে তা লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়।’’
গত কালই সেনাবাহিনী স্পষ্ট করে দিয়েছে, অগ্নিপথ প্রকল্প প্রত্যাহারের কোনও সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু দেশ জোড়া প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সরকারের মাথাব্যথা বহু গুণে বাড়িয়েছে। সূত্রের খবর, অগ্নিপথ প্রকল্পের বিজ্ঞপ্তি জারি, প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে সেনাকে পড়তে হচ্ছে, চার বছরের শেষে অগ্নিপথ প্রকল্পে যোগদানকারী অগ্নিবীরদের কী ভাবে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব এবং এ নিয়ে সেনা কী ভাবছে— এই সব বিষয়গুলি আগামিকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেনাপ্রধানদের বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। মোদী আজ বলেছেন, ‘‘সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে খারাপ মনে হতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতে তার সুফল মিলবে। দেশের স্বার্থে সংস্কারমুখী পদক্ষেপ জরুরি।’’ প্রধানমন্ত্রী ওই বার্তা দিলেও তাতে যুব সমাজ কতটা আশ্বস্ত হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিজেপির অভ্যন্তরেই।
অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি তরুণ সমাজ। ওই ক্ষোভের আগুন যে তাঁদের বিশেষ ভাবে চিন্তায় ফেলেছে, তা দলের অন্দরে মেনে নিচ্ছেন অনেক বিজেপি নেতাই। তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে মূলত পঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষকেরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। আন্দোলন মূলত সীমাবদ্ধ ছিল দিল্লি সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে। তাতেই এক বছর আন্দোলনের শেষে ওই আইনগুলি প্রত্যাহার করেছিল সরকার। কিন্তু বিজেপির পিছন থেকে সরে যায় কৃষক সমাজের একাংশ। কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত আজ জানিয়েছেন, আগামী ২৪ জুন দেশজুড়ে অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবে সংযুক্ত কিসান মোর্চা। ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ইতিমধ্যেই গো-বলয় ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতেও। তেলঙ্গানায় একজনের প্রাণও গিয়েছে ওই বিক্ষোভ-আন্দোলনে।
বিজেপি শিবিরের একটা অংশের মতে, আন্দোলনকারীদের উপর বেশি বলপ্রয়োগ করলে, হিতে বিপরীতের আশঙ্কা। একই সঙ্গে, ওই আন্দোলন স্পষ্ট করে দিয়েছে দেশের বেকারত্ব সমস্যাকেও। বিরোধীদের মতে, মোদী জমানায় বেকারত্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সেই ক্ষোভে ঘৃতাহুতির কাজ করেছে অগ্নিপথ প্রকল্প। অথচ, সরকার চাকরি দেওয়ার পরিবর্তে যুবকদের কাছ থেকে চাকরি কেড়ে নিচ্ছে। ফলে যুব সমাজের সমর্থন হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বিজেপির অন্দরে। গত আট বছরে বিভিন্ন মন্ত্রকে কয়েক লক্ষ খালি পদ পড়ে থাকলেও, নিয়োগ কার্যত বন্ধ। তারই মধ্যে সেনায় স্থায়ী চাকরি কার্যত বন্ধ করে দেওয়ার ওই সিদ্ধান্ত দলের গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্কে বড় মাপের ধস নামাতে পারে বলেই আশঙ্কা দলীয় নেতাদের। কারণ, সেনায় জওয়ান পদে যোগদানকারীদের বড় অংশ আসেন গ্রামীণ ভারত থেকে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি যখন এই রকম, তখন প্রধানমন্ত্রীর পরোক্ষ-আশ্বাসে তেমন আস্থা রাখতে পারছেন না তাঁর দলের অনেক নেতাই। বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘মূল সমস্যা হল চার বছরের চাকরি শেষে অবসর নিতে হবে অগ্নিবীরদের। এটাই মেনে নিতে পারছে না যুব সমাজ। ওই নিয়ম না পাল্টালে বিক্ষোভ থামানো কঠিন। অন্য দিকে, অগ্নিবীর প্রকল্পের যাবতীয় ভিত্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে অবসর গ্রহণের উপরে। কারণ তবেই সরকারের পেনশন খাতে খরচ বাঁচানো সম্ভব হবে। তাই সমাধানসূত্র পেতে প্রকল্পের খোলনলচে বদলের প্রয়োজন।’’ আর তা করলে ফের সমালোচনার ঝড় উঠবে। বিরোধীরা বলবেন, নোটবাতিল, জিএসটি-র মতো অগ্নিপথ প্রকল্পও যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা না করে তড়িঘড়ি রূপায়ণের চেষ্টা হয়েছে। তাতে মুখ পুড়বে সরকারেরই।
আন্দোলনকারীদের মূল দাবি, সেনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পুরনো নিয়মে নিয়োগ। অগ্নিবীরেরা অবসরের পরে বিজেপি অফিসে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন বলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করেছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়। বিরোধীদের মতে, আসল সত্যটা বলে দিয়েছেন বিজয়বর্গীয়। অগ্নিবীরদের পুনর্বাসনের যে প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন মহল থেকে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ওই বিজেপি নেতার মন্তব্য। যাতে বিড়ম্বনায় গোটা পদ্ম শিবির।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।