রাষ্ট্রপুঞ্জের পূর্বাভাস, চিনকে টপকে আগামী বছরেই সব থেকে বেশি জনসংখ্যার দেশ হতে চলেছে ভারত। এই প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে নতুন করে মাথা চাড়া দেওয়া রাজনৈতিক বিতর্কে ফাটল ক্রমশ চওড়া হচ্ছে বিজেপির অভ্যন্তরেও।
এক দিকে, সঙ্ঘ এবং যোগী আদিত্যনাথের মতো কট্টরপন্থী নেতাদের ইঙ্গিত, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কড়া পথে হাঁটার পক্ষপাতী তাঁরা। কিন্তু উল্টো দিকে, অন্তত এখনই দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন আনার কথা ভাবছে না মোদী সরকার।
ফারাক চোখে পড়ছে এ বিষয়ে সংখ্যালঘুদের (বিশেষত মুসলিম) কাঠগড়ায় তোলার ক্ষেত্রেও। সঙ্ঘ তথা আদিত্যনাথ যখন জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্য কার্যত মুসলিম সমাজকেই মূলত দায়ী করছেন, তখন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডবিয়ার বক্তব্য, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক গতিতে কাজ এগোনোয় সরকার এই মুহূর্তে আলাদা করে কোনও আইন চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। তার বদলে বরং সন্তান ধারণের বিষয়ে মহিলাদের সচেতনতা বৃদ্ধির পক্ষে সওয়াল করছেন তিনি।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গে ধর্মীয় পরিচিতি টানা অনুচিত বলে অভিমত রাজ্যসভার সদ্য প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ তথা মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভিরও। যদিও অনেকে মনে করাচ্ছেন, দেশে জনবিস্ফোরণের জন্য এক সময়ে লালকেল্লা থেকে কার্যত একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দিকে আঙুল তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই মতের শরিক আদিত্যনাথও। তাই সেই অর্থে নকভি এ নিয়ে কার্যত তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ফের মেরুকরণের রাজনীতি গত কাল উস্কে দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বলেছেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে, তা দেশে অশান্তি ও নৈরাজ্য ডেকে আনতে পারে। ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, ওই কথায় মূলত মুসলিম সমাজকেই নিশানা করেছেন যোগী। সঙ্ঘ তথা যোগী-শিবিরের মতে, মুসলিমরা হিন্দুদের তুলনায় গড়ে অনেক বেশি সংখ্যায় সন্তানের জন্ম দেন। যার ফলে আগামী দিনে এ দেশে হিন্দুরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। কিন্তু পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২০) বলছে, এ দেশের প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই জন্মদানের হার ক্রমশ কমে আসছে। তা ছাড়া, এখন হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে জনসংখ্যার যা বিন্যাস, তাতে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুদের পারস্পরিক জায়গা বদল বর্তমান জন্মদানের হারে কার্যত অসম্ভব বলেও বিশেষজ্ঞদের দাবি।
মহিলারা মাথা পিছু যত জন শিশুর জন্ম দেন, তাকেই ফার্টিলিটি রেট বা প্রজনন হার অথবা জন্মদানের হার বলে। সমীক্ষা অনুযায়ী, মুসলিমদের মধ্যে জন্মদানের হার আগের থেকে অনেক দ্রুত হারে কমছে। ১৯৯২-৯৩ সালে তাঁদের মধ্যে জন্মদানের হার যেখানে ৪.৪ ছিল, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৩। ১৯৯২-৯৩ সালে হিন্দু পরিবারে গড় জন্মদানের হার ছিল ৩.৩। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৯৪। পরিবার সমীক্ষা অনুযায়ী, সব ধর্মের মধ্যে জন্মদানের হার আগের চেয়ে কমলেও, এখনও এ দেশে মুসলিমদের জন্মদানের হারই সব থেকে বেশি। কিন্তু একই সঙ্গে সমীক্ষা জানিয়েছে, মূলত শিক্ষার প্রসারের কারণে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি করে আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রক ব্যবহারে আসছেন মুসলিম মহিলারা। চতুর্থ জাতীয় পরিবার সমীক্ষার সময়ে যেখানে ১৭% মুসলিম মহিলা আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, সেখানে পঞ্চম সমীক্ষার সময়ে ২৪% জন করেছেন।
বিরোধীদের অভিযোগ, মুসলিমদের মধ্যে জন্মদানের হার বেশি হওয়াকে তুলে ধরেই মেরুকরণের হাওয়া জোরালো করার চেষ্টা করেছেন আদিত্যনাথ বা সঙ্ঘ পরিবার। হিন্দুত্ববাদীদের যুক্তি, ১৯৫১ সালে ভারতে জনসংখ্যার ১২ শতাংশ ছিলেন মুসলিম। সেখানে ২০১১ সালে মুসলিম ছাড়া বাকি ধর্মের মানুষ এ দেশে ৮৩.৮ শতাংশ। সঙ্ঘ পরিবারের দাবি, এই প্রবণতা চলতে থাকলে, আগামী দিনে ভারতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন হিন্দুরাই।
কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে জন্মদানের হার ২.১ হলে, তবেই তা আগামী দিনে জনসংখ্যার স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখতে সক্ষম। পঞ্চম জাতীয় পরিবার সমীক্ষা অনুযায়ী, এ দেশে জন্মদানের হার ইতিমধ্যেই ২.০। বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়ে এই হার ২.১-এর বেশি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণের বেশ কিছু রাজ্যে ওই হার ১.৬ থেকে ১.৭-এর ঘরে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘অহেতুক ভয়ে’ জনসংখ্যায় বাড়তি রাশ টানতে গেলে, আগামী দিনে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে কমবয়সি, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমবে। তখন পর্যাপ্ত কর্মীর অভাবে সমস্যায় পড়বে শিল্প তথা অর্থনীতি। জন্মদানের হার কম হওয়ার কারণে যে সমস্যা তাড়া করেছে জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে। এমনকি বাদ যাচ্ছে না চিনও। বিশেষজ্ঞদের একাংশের আশঙ্কা, যে ভাবে জন্মদানের হার কমছে ও মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে আগামী কয়েক দশকে বৃদ্ধদের দেশে পরিণত হতে পারে ভারতও।
তা ছাড়া, সঙ্ঘ পরিবার হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার যে আশঙ্কা প্রচার করে, তাকেও সত্য বলতে রাজি নন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের যুক্তি, ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা গিয়েছিল, মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি ছিল সব থেকে বেশি। ২০০১-এর জনগণনার তুলনায় ২০১১ সালে জনসংখ্যার সার্বিক বৃদ্ধি ছিল ১৭.৭%। এর মধ্যে মুসলিমদের বৃদ্ধি ২৪.৬%। তার আগের দুই দশকেও ওই বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৩২.৮% (১৯৮১-৯১) ও ২৯.৫% (১৯৯১-২০০১)। সেই তুলনায় ২০০১-২০১১ দশকে হিন্দুদের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৬.৮%। ২০১১ সালের জনসংখ্যা অনুযায়ী, এ দেশের জনসংখ্যার ৭৯.৮% হিন্দু, ১৪.২% মুসলিম। বিশেষজ্ঞদের মতে, জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত যেমন কমছে, তেমনই মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও পাল্লা দিয়ে কমছে। ফলে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা।