এনডিএ-র শরিক থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জোটসঙ্গী হিসেবে বিহারে আসন্ন বিধানসভা ভোটে লড়বে না লোক জনশক্তি পার্টি। নতুন সিদ্ধান্তের পরে দলীয় কর্মীদের উচ্ছ্বাস। রবিবার। ছবি: পিটিআই।
এত দিন কার্যত একতরফা দেখানো বিহার ভোটকে এক ঝটকায় জমিয়ে দিলেন লোক জনশক্তি পার্টির চিরাগ পাসোয়ান।
বাবা রামবিলাস পাসোয়ান অসুস্থ। অস্ত্রোপচার হয়েছে সদ্য। এই পরিস্থিতিতে চিরাগের দল এলজেপি ‘আপাতত’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এনডিএ-র শরিকের ‘মর্যাদা পালন করলেও’ মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জোটসঙ্গী হিসেবে বিহারের আসন্ন বিধানসভা ভোটে লড়বে না তারা। প্রতি আসনে প্রার্থী দেবে মুখ্যমন্ত্রীর দল জেডিইউ-র বিরুদ্ধে। তবে কোথাও বিজেপির বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ে যাবে না তারা।
পাসোয়ানদের এই সিদ্ধান্তের পিছনে বিজেপির হাত রয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ পাসোয়ানদের রণকৌশল দেখে রাজনীতিকরা মনে করছেন, তাঁরা বিজেপির সুবিধা করে দিয়ে নীতিশের ক্ষতি করতে চাইছেন। এই ঘোষণার পরে এনডিএ জোটের জগাখিচুড়ি দশা হল বিহারে। শরিক জেডিইউ-র সঙ্গে বিজেপি ভোটে আসন ভাগাভাগি করে লড়লেও বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর দল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নেই। আবার মন্ত্রিসভায় থাকা রামবিলাসের দল এলজেপি আর এক শরিক জেডিইউয়ের সঙ্গে ব্যালটের টক্করে! আর জেডিইউ-বিজেপি জোট প্রতিপক্ষের তুলনায় মসনদ দখলের সম্ভাবনার নিরিখে অনেকখানি এগিয়ে থেকে শুরু করলেও এলজেপি-র এই সিদ্ধান্ত নীতীশের ১ নম্বর অ্যানে মার্গে ফেরার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে কি না, সে দিকেই আগ্রহী চোখ থাকবে সকলের।
এমনিতে জেডিইউয়ের সঙ্গে এলজেপি-র সম্পর্ক তেতো হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। বিহারে বন্যা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া থেকে শুরু করে ঘরফেরতা পরিযায়ী শ্রমিকদের অবহেলার মতো বিভিন্ন বিষয়ে নীতীশ সরকারের নাগাড়ে সমালোচনা করছিলেন চিরাগ। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, তাঁদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে এনডিএ জোটে জিতন রাম মাঁঝির হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চাকে শামিল করার সিদ্ধান্ত। এতে নাকি তাঁদের মূল দলিত ভোটব্যাঙ্কে চিড় খাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন চিরাগ। কিন্তু নীতীশ সে কথা কানে তোলেননি।
এ দিন বিহারের কৌশল ঠিক করতে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা প্রমুখ। শোনা যাচ্ছিল, বিহারে মোট ২৪৩টি আসনের মধ্যে যথাক্রমে ১২২টি ও ১২১টিতে লড়বে জেডিইউ এবং বিজেপি। এর মধ্যে থেকে নীতীশের দল যেমন জিতনের দলকে আসন ছাড়বে, তেমনই এলজেপি-কে তা ছাড়বে বিজেপি। রামবিলাসের অস্ত্রোপচারের পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা চিরাগের কাছে তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন। কিন্তু আসন ভাগাভাগির আলোচনা নাকি আর তেমন এগোয়নি। দু’দলের তরফে যদিও বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, তা হয়ে ওঠেনি মূলত রামবিলাসের অসুস্থতার কারণেই।
কিন্তু তা হলে বিজেপির বিরুদ্ধে না-লড়ার সিদ্ধান্ত কেন চিরাগের? এই প্রশ্নের উত্তরেই শোনা যাচ্ছে হাজারো জল্পনা। কেউ বলছেন, বেশি আসনে লড়ে এ বার ভোটের শেষে ‘কিং মেকার’ হতে চান চিরাগ। চান এমন আসন পেতে, যাতে তাঁদের বাদ দিয়ে সরকার গড়া কঠিন হয়। সে ক্ষেত্রে দর কষাকষির বিপুল সুযোগ থাকবে তাঁর হাতে। হরিয়ানায় ঠিক যেমনটা করেছিলেন দুষ্মন্ত চৌটালা। কিংবা ইউপিএ জোটের শরিক থাকা সত্ত্বেও ২০০৫ সালে শুধু লালু প্রসাদ যাদবের আরজেডি-র বিরুদ্ধে লড়ে যে জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন রামবিলাস! অনেকের মতে, ২০২০ সালে আসলে ২০০৫ সালের রামবিলাস হতে চাইছেন চিরাগ।
আবার অনেকের মতে, এলজেপি-র এই সিদ্ধান্তের পিছনে পরোক্ষ মদত আছে বিজেপির। ভোটের মুখে জোট-বাধ্যবাধকতায় হয়তো নীতীশের বিহারের জন্য সরকারি প্রকল্পের ঝুলি উপুড় করেছেন মোদী। প্রশংসা করেছেন একে-অপরের। কিন্তু আসলে যে দুই দলের সম্পর্ক দারুণ মধুর, তা নয়। বার বার বিভিন্ন ঘটনায় তা প্রমাণিত। অনেকের ধারণা, এই পরিস্থিতিতে বিজেপি এবং এলজেপি ভাল সংখ্যক আসন পেলে নীতীশকে কুর্সি থেকে সরিয়ে
নিজেদের মুখ্যমন্ত্রী বসাতে পারে মোদী-শাহের দল। সে ক্ষেত্রে উপ-মুখ্যমন্ত্রিত্বের শিকে ছিড়তে পারে চিরাগের কপালে। আবার তেমনটা না-হলেও এখনকার মতো জেডিইউয়ের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়ার পথ খোলা থাকবে। বিজেপি দুই রাস্তাই খোলা রাখতে চাইছে কি না, সেই প্রশ্ন তাই উঠছে।
তবে রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা আগাম বলা শক্ত। তাই ভাল সংখ্যক আসন পেলে, এলজেপি এই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলবে কি না, বা নীতীশের ভোট কাটতে গিয়ে শেষমেশ ভাঙন ধরবে কি না এলজেপির নিজের ভোটব্যাঙ্কেই, সেই দিকে আগামী দিনে চোখ থাকবে সকলের।