ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত নেপাল। ছবি: সংগৃহীত।
এক মাসের মধ্যে তিন-তিন বার। শুক্রবার রাতে নেপালে যে বিধ্বংসী ভূমিকম্পে এখনও পর্যন্ত ১৫৭ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে, সেই কম্পনের জের কিন্তু অনুভূত হয়েছে ভারতের দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ-বিহার জুড়ে। নেপালে কম্পন আর তার রেশ ভারতে ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও এক মাসের মধ্যে তিন বারই ঘটল। ভূকম্পবিদেরা সাবধান করে বলছেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। হিমালয় অঞ্চলের গভীরে টেকটনিক প্লেটে ঠোকাঠুকি হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে আরও বড় ভূকম্পের সম্ভাবনা আছে। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছুঁতে পারে ৮.৫ অবধি।
দিল্লি এবং তার সংলগ্ন এলাকায় এ ভাবে বারবার কাঁপুনি ধরায় স্বাভাবিক কারণেই ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। ভূকম্পবিদেরা জানাচ্ছেন, কম্পন-প্রবণতার নিরিখে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন এলাকাকে বিভিন্ন জ়োনে ভাগ করা হয়। এ দেশের রাজধানী অঞ্চলটি পড়ে চার নম্বর জ়োনে, যেটা ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস-এর তৈরি কম্পন-মানচিত্র অনুযায়ী এমনিতেই খুব ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ার কারণেই এখানে কম্পনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। হিমালয় পার্বত্য এলাকা ও সংলগ্ন স্থানে ভবিষ্যতে রিখটার স্কেলে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাও অসম্ভব নয় বলে মনে করছেন তাঁরা।
প্রশ্ন হল, এই চার নম্বর জ়োন তথা হিমালয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে কম্পনের প্রবণতা বেশি কেন? বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূতাত্ত্বিক বিশেষত্ব, দুই-ই এর জন্য দায়ী। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আজ থেকে ৪-৫ কোটি বছর আগে টেথিস সাগর থেকে হিমালয় পর্বতমালার জন্মই হয়েছিল ভূগর্ভে ভারতীয় টেকটনিক প্লেট আর ইউরেশীয় টেকটনিক প্লেটের ধারাবাহিক সংঘর্ষের ফলে। এবং ওই ভূগর্ভে টেকটনিক প্লেটের নড়ানড়ি এখনও চলছে। ফলে হিমালয়ের নিকটবর্টী অঞ্চলগুলি স্বাভাবিক ভাবেই কম্পনপ্রবণ। ভারতের রাজধানী লাগোয়া অঞ্চল হিমালয়ের ২০০-৩০০ কিলোমিটারের মধ্যেই। ফলে সেখানে কম্পনের ঝুঁকি এমনিতেই বেশি।
টেকটনিক প্লেটের নড়নচড়ন মানেই হয় ভূমিকম্প, হয় ভূমিধস। সাম্প্রতিক অতীতে বারবার ধসের কবলেও পড়েছে হিমাচল এবং উত্তরাখণ্ড। ভূকম্পবিদরা বলছেন, নেপাল-উত্তরাখণ্ড এবং দিল্লি-সহ হিমালয়ের বাকি নিকটবর্তী অঞ্চল স্বাভাবিক নিয়মে কম্পনপ্রবণ তো বটেই, সেই সঙ্গে এদের অবস্থানের বিশেষত্ব সেই ঝুঁকি আরও অনেকটা বাড়িয়ে তুলেছে। কী সেই বিশেষত্ব? হিমালয়ের এই এলাকার নীচেই অবস্থান করছে টেকটনিক প্লেটের সীমান্ত অঞ্চল। অর্থাৎ ভারতীয় টেকটনিক প্লেট আর ইউরেশীয় টেকটনিক প্লেটের সংঘাতস্থল। যে ভারতীয় টেকটনিক প্লেট ক্রমশ উত্তরমুখে এগিয়ে ইউরেশীয় প্লেটের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল এবং হিমালয়ের জন্ম দিয়েছিল, সেই ভারতীয় প্লেটের উত্তরায়ণ এখনও শেষ হয়নি। ফলে ফের সংঘাত বাধছে, তার চাপ আসছে হিমালয়ের উপরে। পর্বত তার জেরে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাকে সঙ্গে নিয়ে কেঁপে উঠছে।
ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অব হিমালয়ান জিয়োলজির প্রাক্তন গবেষক অজয় পাল বলছেন, এই অঞ্চলটি দৃশ্যতই বারবার সক্রিয় হয়ে উঠছে, যার জের ছড়িয়ে পড়ছে ভারতেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানী লাগোয়া এলাকা প্রাকৃতিক ভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ। তার উপরে আবার সেখানে অগুন্তি গগনচুম্বী অট্টালিকার ভিড়, অপরিকল্পিত বসতির জোয়ার। ফলে মাটির নীচের চাপের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে উপরের চাপ। বাড়ছে বিপদের শঙ্কা, বৃহত্তর ভূমিকম্পের সম্ভাবনাও। কিন্তু কবে সেই বিপদ এসে উপস্থিত হবে, তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয় আবহওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার মতো করে। তাই নিয়মিত সতর্কতাই একমাত্র রাস্তা। দিল্লির বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের প্রাক্তন সিইও কুলদীপ সিংহ গঙ্গর বলছেন, আরও বেশি করে এবং নিয়ম করে মক ড্রিল চালিয়ে যাওয়া জরুরি।