ছবি: এপি।
গুলমার্গ খাঁখাঁ। সোনমার্গ শূন্য। পহেলগাম ফাঁকা। এক জনও পর্যটক নেই শ্রীনগরের কোনও হোটেলে। শাল-টুপি-উপহারের দরাদরি নেই। ঝাঁপ নামানো প্রায় সব দোকানের। ডাল লেকে প্রায় ৯০০ হাউসবোট। সবই তালাবন্দি। ৩০ বছরের মধ্যে দুর্গাপুজোয় এতটা পর্যটকহীন হয়নি কাশ্মীর। প্রতি পুজোয় কাশ্মীরের যে কোনও অংশ ঠাসা থাকে বাঙালি পর্যটকে। এ বার ভূস্বর্গ পুরোপুরি বাঙালিহীন। আজ নিয়ে ৫৮ দিন ধরে চলছে এই অবস্থা। এরই মধ্যে জম্মু-কাশ্মীরের ৩১০টি ব্লক উন্নয়ন পরিষদে ২৪ তারিখ ভোট করানোর জন্য আজ বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য প্রশাসন বলছে, বিধিনিষেধ যেটুকু রয়েছে তা জাতীয় স্বার্থে জরুরি। আর সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য থাকা দরকার।
বছরের শুরুটা এমন ছিল না। শুধু মার্চ-এপ্রিলেই ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ভ্রমণপিপাসুর পা পড়েছিল টিউলিপ গার্ডেনে। রাজ্যে বাড়তি আধাসেনা মোতায়েনের পর থেকেই বুকিং বাতিল হতে থাকে অশান্তির আশঙ্কায়।
৫ অগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘোষণার ঠিক আগে, সন্ত্রাসবাদী হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়ে অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে রাজ্য থেকে বিদায় করা হয় ২৫ হাজার পুণ্যার্থী ও পর্যটককে। হোটেল মালিক সংগঠনের মাজিদ কাপরার কথায়, ‘‘কার্গিল যুদ্ধের সময়েও পর্যটক আসা বন্ধ হয়নি জম্মু-কাশ্মীরে। কিন্তু এ বার পুজোয় বাংলা বা দেশের কোনও প্রান্ত থেকেই কোনও পর্যটক আসেননি। ৫ অগস্টের পর কেউই আসছেন না। নয়তো এই সময়টা সব হোটেল পর্যটকে ভর্তি থাকে।’’ ডাল লেকে ঘুরে বেড়ায় শয়ে শয়ে শিকারা। শিকারার মালিক-মাঝিরা এখন লেকের ধারে সার বেঁধে বসে। আনাজ বেচছেন পেট চালাতে। শিকারা মালিকদের সংগঠনের সম্পাদক সাদিক বাকাল বললেন, ‘‘প্রায় দু’মাস ধরে বিধিনিষেধ। পরিবারগুলোকে তো খাওয়াতে হবে!’’
উপত্যকায় পর্যটনের ভরসায় রুটি-রুজি চলে ২০ হাজারের বেশি মানুষের। পরোক্ষ ভাবে যুক্ত আরও কয়েক লক্ষ মানুষ। টানা বিধিনিষেধে সকলেই বিপাকে। বিষয়টি নিয়ে আজ শুনানি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। কেন্দ্রীয় সরকার হলফনামা দিয়ে শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরে যেটুকু বিধিনিষেধ রয়েছে, জাতীয় স্বার্থে এবং শান্তি বজায় রাখার জন্য তা জরুরি। আর জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন জানিয়েছে, উপত্যকায় ল্যান্ডলাইন ফোন ১০০ শতাংশ কাজ করছে। দিনের বেলা লোকজনের চলাচলে কোনও বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু মোবাইল ও ইন্টারনেট? জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসনের তরফে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বিচারপতি এন ভি রামান্নার বেঞ্চকে জানান, মোবাইল-ইন্টারনেট চালু করলেই গুজব ছড়াবে। সীমান্তবর্তী এলাকায় উত্তেজনার প্ররোচনা দেওয়া হবে। যার জেরে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সাংবাদিক ও সাধারণের জন্য কিছু জায়গায় ইন্টারনেট কিয়স্কের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে মোট ৯টি আবেদন নিয়ে শুনানি হয় এ দিন। উপত্যকার এক পত্রিকার সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন, সমাজকর্মী তেহসিন পুনাওয়ালা সংবাদমাধ্যমের পেশাদারদের তরফে পরঞ্জয় গুহঠাকুরতাদের যদিও অভিযোগ, কাশ্মীরে জনজীবন পুরো স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, ‘‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা দরকার।’’ মানুষের গতিবিধির উপরে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দু’সপ্তাহের মধ্যে প্রশাসনকে হলফনামা দিতে বলেছে আদালত। বিষয়টি নিয়ে ফের শুনানি হবে নভেম্বরে।
প্রশাসন পঠনপাঠন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানালেও অভিভাবকরাই বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে সাহস পাচ্ছেন না। সত্যাসত্য যাচাই না করে সংবাদ ও সমাজ মাধ্যমে কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে প্রচারও চলছে। বলা হচ্ছে, নেতা, আম-কাশ্মীরি মিলিয়ে আটক অন্তত কয়েক হাজার। তার মধ্যে ৯ বছরের শিশুও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত চার সদস্যের কমিটি জানিয়েছে, আটকদের মধ্যে কোনও শিশু নেই। পাথর ছোড়ায় কয়েক জন নাবালককে ধরা হয়েছে। বিজেপি নেতা রাম মাধবের দাবি, ‘‘কাশ্মীরে আটক মাত্র ২০০-২৫০ জন। তাঁরাও বিলাসবহুল বন্দোবস্তে রয়েছেন।’’