সাংবাদিকদের হেনস্থার প্রতিবাদ শ্রীনগরে।—ছবি পিটিআই
নিষেধাজ্ঞার ১০১তম দিন আজ পূর্ণ করল কাশ্মীর। রোজকার সমস্যার কথা নতুন আর কী বলব। জানি না ইন্টারনেটটা কবে চালু হবে। সরকার এ নিয়ে কিছু বলছেও না। অথচ পড়াশোনা থেকে ব্যবসা— সবই মুখ থুবড়ে পড়ছে ইন্টারনেট না-থাকায়।
নিজের কথাই বলি। খবর জোগাড় থেকে ‘কপি’ পাঠানো— গোটাটাই এখন আমার কাছে যুদ্ধ। ছেলেমেয়ের স্কুল সেই ৫ অগস্ট থেকে বন্ধ। তবু বাড়িতে ইন্টারনেট থাকলে স্কুলের সঙ্গে যোগ থাকত। ওদের লেখাপড়ার এখন ছন্নছাড়া দশা। আমার ভাই ইশফাক এক জন শিক্ষক। পাশাপাশি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রথম ধাপটা পেরিয়েছে ও। কিন্তু কাশ্মীরে ইন্টারনেট নেই বলে ওকে পঠানকোটে গিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষার ফর্ম অনলাইনে জমা দিতে হয়েছে!
আমি কাজে বেরোই সকাল ১১টায়। প্রেস ক্লাবে যাই, তার পরে সরকারের তৈরি করা মিডিয়া সেন্টারে। খবর জোগাড় করতে ঘণ্টা দুয়েক কাটে। ৩টে অবধি খবর লিখে পেন ড্রাইভে সেই ‘কপি’ নিয়ে আবার মিডিয়া সেন্টার দৌড়। সেখানে ঘণ্টাখানেক লাইন দিয়ে কম্পিউটারে বসতে পাই। আগে খবরের খোঁজে যে কোনও জায়গায় নিজে যেতে পারতাম, যে কোনও জায়গায় বসে স্টোরি পাঠাতে পারতাম। এখন ইন্টারনেট নেই বলে বাড়ি থেকে মিডিয়া সেন্টার— এক কিলোমিটার যাওয়াটা রোজকার রুটিন। মিডিয়া সেন্টারেও এত ভিড়, ইন্টারনেটে বসে কয়েকটা ওয়েবসাইট দেখার কোনও প্রশ্ন নেই। অনেক সময়ে অফিসের মেলও চেক করতে পারিনি। নিজের ‘কপি’ পাঠিয়েই কম্পিউটার ছেড়ে দিতে হয়েছে।
জরুরি চিঠিপত্র কিছুই আসছে না। কাশ্মীরের কুরিয়র সংস্থাগুলোর সংগঠনের প্রেসিডেন্ট জ়াহুর কারি জানালেন, কড়াকড়ি শুরুর দিন থেকে তাঁদের কাজকর্ম প্রায় বন্ধই। কারণ চিঠি বা পার্সেল কোথায়, কাকে পাঠাতে হবে, তা কখন, কী অবস্থায় আছে— এই পুরো সমন্বয়টা তো ইন্টারনেটেই হয়। জ়হুর বলছিলেন, ‘‘অনেকে জীবনদায়ী ওষুধ আনাতে পারছেন না। কেউ কেউ অন্য রাজ্য থেকে প্যাথলজির পরীক্ষা করান। রক্তের নমুনা কুরিয়রে যেত। বাড়িতে বসে দেখা যেত রিপোর্ট। সে সব কিছুই হচ্ছে না।’’
পর্যটনে ইন্টারনেটের ভূমিকা বিরাট। ফলে ক্ষতি হচ্ছে সেখানেও। পর্যটন ব্যবসায়ী নাসির শাহ বললেন, ‘‘ইন্টারনেটে বুকিং কনফার্ম করতে আমাকে জম্মু যেতে হয়েছিল। গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করাটাই মাথাব্যথা।’’ ‘ফল মান্ডি’ বা কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসাও ভাল ধাক্কা খেয়েছে। দালালদের এড়িয়ে কাশ্মীরি আপেল রাজ্যের বাইরে বিক্রির একটা সুযোগ ছিল চাষিদের কাছে। এখন সেই রাস্তাও বন্ধ। সীমাহীন দুর্দশা তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে। তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ইয়াফের নাজ়ির বললেন, ‘‘বেশির ভাগ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা উপত্যকা থেকে পাততাড়ি গোটাচ্ছে। যারা কাজ দিচ্ছে, তারা তো ইন্টারনেট নেই বললে শুনবে না! ফলে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে সংস্থাগুলোর।’’
২০১২ সালে কাশ্মীরে মোট ৯ ঘণ্টা বন্ধ ছিল ইন্টারনেট। ২০১৯-এ ৩০০০ ঘণ্টারও বেশি। সমীক্ষা বলছে, বারবার ইন্টারনেট বন্ধের ধাক্কায় ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত কাশ্মীরের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা!
শীত এসেছে। তুষারপাতে ৫ দিন বন্ধ থাকার পরে আজ জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ে খুলেছে। ১৩০০ গাড়ি আটকে ছিল সেখানে। গোটা সপ্তাহই নাকি বরফ পড়বে। সে আর এক ভোগান্তি।
কাশ্মীরে এখন ভোগান্তির নামই বেঁচে থাকা।