সে দিন সকালেও ভাবতে পারিনি, সাক্ষী হতে চলেছি ইতিহাসের এমন এক সঙ্কটময় মোড়ের।
দিনটা শুরু হয়েছিল ভোর ৫টায়। ফৈজাবাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে ৫ কিলোমিটার দূরের অযোধ্যার পথে যখন যাত্রা শুরু, তখন ঘড়ির কাঁটায় ৬টা। উত্তরপ্রদেশের শীতের সকাল। হু-হু করে হিমশীতল হাওয়া বইছে। তবে দিনটা রোদ ঝলমলে। পথের দু’পাশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন। হাত দেখিয়ে ‘প্রেস’ স্টিকার লাগানো গাড়ি থামালেন একদল যুবক। মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। সারথির নাম বজরংবলি। তবু রামভক্তদের দেখে সে বেশ ঘাবড়ে গেল। গাড়ির কাচ নামিয়ে সওয়াল শুরু করার আগেই পোয়া-ভাঁড় ভর্তি দুধেল এলাইচি-চা এল। সঙ্গে লেড়ো বিস্কুট। যুবকদের বক্তব্য, অযোধ্যায় ভিড় বাড়াবেন না তাঁরা। শীতের সকালে পথচলতি মানুষকে চা খাইয়েই তাঁদের ‘করসেবা’ চলছে।
লক্ষ মানুষের ভিড় ঠেলে প্রথম গন্তব্য সরযূতীর। রামলীলা ময়দান থেকেই ‘মুঠিভর বালি’ নিয়ে করসেবকদের জন্মভূমি-যাত্রার কথা। কিন্তু কোথায় কী? ধূ-ধূ করছে নদীর তীর। জনস্রোতের লক্ষ্য তখন করসেবাস্থল। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি রেখে সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতে করসেবা স্থলে। পাশেই বিতর্কিত এলাকা, বিতর্কিত কাঠামো। কেউ বলেন বাবরি মসজিদ, কেউ বলেন রামমন্দির। ‘নিশ্ছিদ্র’ নিরাপত্তা। কাঠামোর ঘেরাটোপের বাইরে করসেবাস্থলের কংক্রিটের চত্বর পরিষ্কার ঝকঝকে। জুলাইয়ে একদফা করসেবার নামে বিতর্কিত জমির বাইরে তৈরি হয়েছিল সেই চত্বর। এবারের করসেবার জন্যও সেই চত্বরকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
গলায় ঝোলানো ‘রাম জন্মভূমি ন্যাস’-এর গোলাপি পরিচয়পত্র। প্রেস কার্ড। দৈনিক রুটিনটা সেরে নিলাম। রামলালা সকাশে ঢুঁ। ভিতরে ব্যস্ত ফৈজাবাদের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এসএসপি) ডি বি রাই। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আরও একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন তিনি। বললেন, ‘‘মাছিও গলতে পারবে না!’’ ৫ তারিখেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সহ-সভাপতি বি পি তোষণিওয়াল বলেছিলেন, করসেবকরা রামলীলা ময়দান থেকে বালি নিয়ে এক এক ব্যাচে হাজার জন করে রওনা দেবেন করসেবার জন্য। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে হবে আইনমাফিক করসেবা।
করসেবার মঞ্চে অশোক সিঙ্ঘল, উমা ভারতী, লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর জোশী, বিনয় কাটিয়ার। ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: অবশেষে কাল বাবরি মসজিদ মামলার রায়, চার নজরে ২৮ বছর
করসেবাস্থল সংলগ্ন পরিষদের ক্যাম্প অফিস— ‘রামকথা কুঞ্জ’। সামনে বিশাল মাঠ। তারপর ৭ ফুট উঁচু সরকারি প্রাচীর— ‘রাম দিওয়ার’। তারপরেই কংক্রিটের চত্বর— ‘করসেবাস্থল’। রামকথা কুঞ্জেই পাকড়াও করলাম তোষণিওয়ালকে। বললেন, ‘‘কেউই আসলে অতদূরে থাকতে রাজি নন। তাই সকালেই ঠিক হয়েছে, সরযূর বালি নিয়ে রামকথা কুঞ্জের বিশাল প্রান্তরেই করসেবকরা জমা হবেন। সেখান থেকেই তাঁদের ছোট ছোট ব্যাচে করসেবাস্থলে পাঠানো হবে।’’ শেষ মুহূর্তের ওই সিদ্ধান্ত বদল করসেবকদের সন্তুষ্ট রাখতে? নাকি অন্য কোনও কারণে? তবে সকাল ৮টায় তেমনকিছু মনে হয়নি।
তবে তখনই কুঞ্জ এবং সংলগ্ন অ্যাপ্রোচ রোডে করসেবকদের ভিড় উপচে পড়ছে। সঙ্গে গগনভেদী হুঙ্কার ‘জয় শ্রীরাম’। তাঁদের সামলাতে রাম দিওয়ারের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের খাকি হাফপ্যান্ট (তখনও সঙ্ঘে ফুল প্যান্ট চালু হয়নি), সাদা জ্যাকেট আর সোয়েটার পরা স্বেচ্ছাসেবকরা। আগের রাতেই পরিষদের মুখপাত্র রামশঙ্কর অগ্নিহোত্রী জানিয়েছিলেন, সাংবাদিকদের করসেবার অনুষ্ঠান ভাল ভাবে দেখতে দেওয়ার জন্য বাবরি মসজিদের ঠিক সামনে, পূর্বদিকের মানস ভবনের ছাদে তৈরি হয়েছে প্রেস গ্যালারি। সামনে বিতর্কিত কাঠামো। নীচে উন্মুক্ত করসেবাস্থল। বাঁ-দিকে রামকথা কুঞ্জের অস্থায়ী একতলা অফিস। সেটার ছাদই ভিভিআইপি মঞ্চ। সেখান থেকেই ভাষণ দেবেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক এইচ ভি শেষাদ্রি, গুরুত্বপূর্ণ নেতা কে এস সুদর্শন, মুরলী মনোহর যোশী, রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়ারা। সুতরাং প্রেস গ্যালারিতে ‘পজিশন’ নেওয়ার জন্য সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি। ছাদে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়েও নেমে এলাম নীচে। মনে হল, গ্যালারিতে বসে দেখার চেয়ে সাইডলাইনের ধারে বসে খেলা দেখার মজা আলাদা! সামনের দরজায় স্বেচ্ছাসেবকরা। অতএব খিড়কিদোরই ভরসা। বেরিয়ে এসে প্রেস কার্ড দেখিয়ে ঢুকে গেলাম করসেবাস্থলে।
ভিড় তখনও সংযত। ফাইল চিত্র।
বিশৃঙ্খল করসেবকদের সামলানোর দায়িত্ব সঙ্ঘের ‘অনুশাসিত’ স্বেচ্ছাসেবকদের। তার মধ্যেই তদারকি করে বেড়াচ্ছেন আমিতাভ বচ্চন সম উচ্চতার ‘পহেলবান ধরমদাস’। ছাতি ‘৫৬ ইঞ্চি’র কম তো নয়ই। একদা বিনয় কাটিয়ারের ছায়াসঙ্গী পালোয়ান তত দিনে গেরুয়া বসনধারী ‘স্বামী ধর্মদাস’। তবে ‘পহেলবান’ ভাবমূর্তি ছাড়েননি। করসেবাস্থলে তত ক্ষণে শিষ্যদের নিয়ে হাজির আচার্য বামদেব। পুজোপাঠের প্রয়োজনীয় সাজসজ্জা শুরু হয়েছে।
সকাল ১০টা নাগাদ দেখলাম সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত পর্যবেক্ষক তেজশঙ্কর এক কোণে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে সব পর্যবেক্ষণ করছেন। কয়েক দিন আগেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে দিল্লিতে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বেঙ্কটচেলাইয়ার এজলাসে। করসেবার অনুমতি দিয়ে সে দিনই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ তাঁকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে। কেমন বুঝছেন? হাসলেন তেজশঙ্কর, ‘‘এভরিথিং ইজ ফাইন।’’
রামকথা কুঞ্জের মঞ্চ থেকে তখন ভেসে আসছে রামভজন। আর মাঝে মাঝেই করসেবকদের উদ্দেশে সতর্কবাণী— ‘‘অনুশাসিত রহিয়ে।’’ কখনও ‘রাম কা নাম বদনাম’ না-করার পরামর্শ। করসেবা পরিসরের এক কোণে, বিতর্কিত এলাকা ঘেঁষে একটা মাটির ঢিপি। সেখান থেকে চারপাশটা পরিষ্কার দেখা যায়। সেটার উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে থাক-করা কয়েকটা ইটের উপরে তখন বসে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের প্রাক্তন ডিজি তথা বারাণসীর বিজেপি সাংসদ শ্রীশচন্দ্র দীক্ষিত। তিনি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদেরও সহ-সভাপতি। পাশেই ফৈজাবাদ ডিভিশনের ডিআইজি উমাশঙ্কর বাজপেয়ী। তিনিও জানালেন, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। করসেবাস্থলের চাতালে জড়ো হচ্ছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধুরা। মাঝখানে ঝকঝকে তামার কলস। তাতে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা হচ্ছে। কলসে আম্রপল্লব। আমের পল্লব আর ফুলমালায় সাজানো পুজোর আসর। চারপাশে সাধুদের বসার জায়গা। ১২টা ১৪ মিনিটে এখানেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মার্গদর্শক মণ্ডলীর প্রধান, আচার্য বামদেবের পৌরোহিত্যে শুরু হবে পুজোপাঠ এবং সাধারণ করসেবকদের করসেবা।
এরই মধ্যে সপার্ষদ হাজির চিত্রকূটের বৈষ্ণবাচার্য হরিচরণ দাস। সঙ্গে তাঁর শিষ্য তথা ‘টিন এজ’ সাধু রঘুনন্দন। ফর্সা, দোহারা চেহারা। নির্দিষ্ট আসনে বসে রঘুনন্দন তাঁর গেরুয়া ঝোলা থেকে দু’টি ছোট কর্নিক বের করতেই তেড়ে এলেন পহেলবান। কর্নিক নিয়ে টানাটানি চলতে চলতেই রঘুনন্দনকে কাঁধে তুলে নিয়ে পহেলবান ধেয়ে গেলেন উত্তর-পূর্ব কোণের গেটের দিকে। কার্যত পরিসরের বাইরে ছুড়ে ফেললেন টিন এজ সাধুকে।
১৯৯১ সালের ৩১ অক্টোবর একই ভাবে করসেবকদের গম্বুজে চড়তে দেখেছি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এ বার যে অন্য কিছু হবে, ভাবতে পারিনি। ফাইল চিত্র
আরও পড়ুন: এত দিনে বাবরি ধ্বংসের রায়! অক্ষমের উল্লাস ছাড়া আর কী?
পহেলবানের ‘দাদাগিরি’-তে যেন আগুনে ঘি পড়ল। করসেবকদের জমাট ভিড় আছড়ে পড়ল গেটের উপর। সঙ্ঘের স্বেচ্ছাসেবকরা সেই চাপ সামলাতে পারলেন না। শ’দুয়েক যুবক ঢুকে পড়ল করসেবাস্থলের মধ্যে। হাতে তাদের প্রমাণ সাইজের ঝকঝকে ত্রিশূল। শুরু হল উন্মত্ত নাচ। মুখে ‘জয় শ্রীরাম’। সঙ্গে সেই লয়ে-সুরে শরীর দোলানো। ফিল্মি হিরোদের ভঙ্গিতে কেউ তাণ্ডব, কেউ ব্রেক ডান্স, কেউ আবার ডিস্কো। রামের নামে এমন নাচও রামজন্মভূমি আন্দোলনেরই আমদানি। তাঁদেরই একজন রাজস্থান থেকে আসা মণিরাম। শীর্ণ গড়নে গরিবির ছাপ স্পষ্ট। আমার বুকে প্রেস কার্ড দেখে রক্তচক্ষু মণিরাম। তার আগের দু’বছরে বহুবার যুবাভক্তদের এমন রক্তচক্ষু দেখেছি। পত্রকারকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে যেন অর্ডার দেওয়ার ঢঙেই মণিরাম বললেন, ‘‘জয় শ্রীরাম।’’ ঠেকে শিখেছি অনেক। তবু সেদিন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ভয় লাগছিল। প্রতি সম্ভাষণে বললাম, ‘‘জয় শ্রীরাম।’’ এর পরেই জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, আদালতের নির্দেশ মানবেন তো? প্রশ্নটা আগুনে ঘৃতাহুতি দিল। আরও কয়েকজন জড়ো হয়ে হাতের অশালীন মুদ্রা সহযোগে আদালতের বাপবাপান্ত করতে শুরু করল। হাওয়া গরম হচ্ছে দেখে নাগপুরের এক স্বেচ্ছাসেবক হাতজোড় করে সরে যেতে বললেন। সরে গেলাম। ইতিমধ্যে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা সঙ্ঘের বিশেষ লাঠিধারী বাহিনী তেড়ে এল তাদের দিকে। এলোপাথাড়ি লাঠি আর ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে বার করে দিল তাদের।
ঘড়িতে বেলা ১১টা। ফিরে এলাম মাটির ঢিবির উপরে। এত ক্ষণ নোটবই-পেন হাতে ছিল। গলায় প্রেস কার্ড। সে সব গুটিয়ে পকেটে চালান করলাম। বার করলাম আগের দিন ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর তৎকালীন অ্যাসোসিয়েট এডিটর স্বপন দাশগুপ্তের মজা করে কিনে দেওয়া ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা সিল্কের ফেট্টি। ৬ ডিসেম্বরের বারবেলায় সেই ফেট্টি বাঁধলাম মাথায়। রক্ষাকবচ! রামকথা কুঞ্জের মাইকে তখন ভজন থেমে গিয়েছে। বার বার ‘অনুশাসন’-এর হুঁশিয়ারি আসছে। ভেসে আসছে সিঙ্ঘলের গলা, কাটিয়ারের গলা, ‘‘যাঁরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন তাঁরা আমাদের লোক নয়। করসেবা ভণ্ডুল করতে আসা ষড়যন্ত্রী। পিভি, মুলায়ম, ভিপি-র পাঠানো লোক। তাদের কোনও প্ররোচনায় পা দেবেন না।’’
এরই মধ্যে শিবসেনা সাংসদ মোরেশ্বর সাভেকে নিয়ে করসেবাস্থলে এলেন অশোক সিঙ্ঘল। হনুমানগড়ির দিক থেকে ভিড় ঠেলে দুজনে ঢুকতেই শৈবসৈনিকদের তুমুল আওয়াজ উঠল— ‘‘জয় ভবানী, হর হর মহাদেও।’’ সাভেকে ষোল আনা ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দিয়ে করসেবাস্থল ঘুরিয়ে দেখালেন সিঙ্ঘল। মিনিট দশেকের মধ্যেই এলেন আডবাণী, জোশী। চোখাচোখি হতেই জোশী জানতে চাইলেন, কবে এসেছি। তার পর দু’জন চলে গেলেন রামকথা কুঞ্জের মঞ্চে। হনুমানগড়ির দিকের অপরিসর রাস্তায় করসেবকদের সংখ্যা তখন নদীর স্রোতের মতো আছড়ে পড়ছে সংকটমোচনের গেটে। খাকি বাহিনী গলদঘর্ম। হাতাহাতিতে অনেকেই অল্পবিস্তর আহত। পাশেই মোটা লোহার পাইপের ৮ ফুট উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা দর্শনপথ। রামলালা দর্শনে বিতর্কিত কাঠামোর মধ্যে ঢোকার জন্য। তিনটি পথের মুখেই সরকারি মেটাল ডিটেক্টর গেট। দেখলাম ধস্তাধস্তির মধ্যেই সেই বেড়ার উপরে চড়ে বসেছেন বেশ কিছু করসেবক। তাঁদের আটকাতে ধরমদাস পালোয়ানও রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে।
হঠাৎ দেখি ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর মণিময় দাশগুপ্ত, অশোক মালিক এবং ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’-র এসএনএম আবদি এসে দাঁড়িয়েছেন। মণিময় আর আমি হোটেলের একই রুমে রয়েছি। করসেবাস্থলে এসেছিও এক সঙ্গে। তার পরে ছিটকে গিয়েছিলাম। মণিময় বলল, ‘‘আমরা এইমাত্র পিছনদিক থেকে আসছি। ওখানে গাঁইতি, শাবল, হাতুড়ি আর মোটা দড়ি নিয়ে কয়েকশো করসেবক জড়ো হয়েছে।’’ বুঝলাম, এরা অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আসা সেই রাগী যুবকদের দল। কয়েকদিন আগে করসেবকদের বিভিন্ন শিবিরে কপির সন্ধানে ঘুরেছি। সব রাজ্যের শিবিরেই অবাধে ঢুকেছি। কথা বলেছি। বাংলার শিবিরে গিয়ে ‘আনন্দবাজার’ তকমার সুবাদে চা-ও খেয়েছি। আটকে গিয়েছি শুধু অন্ধ্রের ওই শিবিরে। জবাবদিহি, তর্ক করেও লাভ হয়নি। ফেরত আসতে হয়েছে। কয়েকদিন আগেও তাঁদের দেখেছি কাঁধে মোটা দড়ি নিয়ে ঘুরতে। কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা বড়জোর শ’খানেক। সুতরাং বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। আবদি বললেন, ‘‘মসজিদ অক্ষত থাকবে বলে মনে হয় না।’ কিন্তু তখনও নাগপুরের তথাকথিত অনুশাসনের উপর আস্থাশীল হয়ে বললাম, যদি চড়েও বসে, তা হলেও বড়জোর কাঠামোর তিন গম্বুজের মাথায় গেরুয়া ঝাণ্ডা ওড়াবে। তার বেশি কিছু করতে পারবে না।
বিতর্কিত কাঠামোর দিকে আচমকাই বন্য বাইসনের মতো ধেয়ে আসছেন করসেবকরা। ফাইল চিত্র।
আসলে তার আগে ১৯৯১ সালের ৩১ অক্টোবর একই ভাবে করসেবকদের গম্বুজে চড়তে দেখেছি। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে ভিতরে মোতায়েন সিআরপি জওয়ানরা তাদের নামিয়ে এনেছে। কয়েক মাস আগেও একই ভাবে কয়েকশো করসেবক চড়াও হয়েছিল কাঠামোয়। বাইরের প্রাচীরের খানিকটা তারা ভেঙেও ফেলে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার বেশি এগোতে পারেনি। আর এ বারে তো নিরাপত্তা কয়েক গুণ বেশি। তাই আবদির আশঙ্কাকে পাত্তা দিইনি। ভাবিনি দাঁড়িয়ে রয়েছি ইতিহাসের এক সঙ্কটময় মোড়ে।
ভিতরে ভিতরে উত্তেজনার পারদ বেড়ে চলেছে। একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি। হঠাৎই একজন করসেবক এসে সিগারেট চাইলেন। সিগারেটটা দিয়ে তাঁকে একপাশে টেনে আনলাম। নাম শঙ্কর। বাড়ি শরদ পওয়ারের বারামতী জেলায়। তাঁর সাফ কথা, ‘‘আদালতের আদেশ মানি না। নেতাদেরও মানি না। আমাদের নিয়ে প্রত্যেকবার রাজনীতি হচ্ছে। বার বার ডেকে ফেরত পাঠাচ্ছে নেতারা। এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।’’
ঘড়ি বলছে বেলা সাড়ে ১১টা। পরিষদের স্থানীয় নেতা মহেশ নারায়ণ সিংহ মাইকে লাগাতার ঘোষণা শুরু করেছেন, ‘‘আমাদের কাজে যারা বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করছে তারা কেউ রামভক্ত নয়। এরা কেউ করসেবকও নয়। মুলায়ম, ভিপি, নরসিমা রাওয়ের পাঠানো লোক। ওদের ফাঁদে করসেবকরা পা দেবেন না।’’ কিন্তু নেতৃত্বই তো তখন প্রশ্নের মুখে! ঢিপির উপর দাঁড়িয়ে দেখলাম, আরও একটা দল ঢুকে পড়ল করসেবাস্থলে। ধরমদাস একটা বেতের লাঠি নিয়ে বেধড়ক পিটতে শুরু করলেন তাঁদের। করসেবকরা খানিকটা পিছু হটলেও পরের মুহূর্তেই পালোয়ান ভূমিশয্যা নিলেন। তাঁর উপরে চলতে লাগল এলোপাথাড়ি ঘুসি আর লাথি। কোনও মতে উঠে গেরুয়া লুঙ্গি হাঁটুর উপরে তুলে ধরমদাস পড়ি কি মরি দৌড় লাগালেন।
প্রতিরোধের সেই শেষ।
গোটা কাঠামো তখন করসেবকদের দখলে। পাঁচিলের উপর, কাঠামোর ছাদে, গম্বুজে থিক থিক করছে করসেবক। ফাইল চিত্র।
একদিকে ধরমদাস পালাচ্ছেন রামকথাকুঞ্জের দিকে, অন্যদিক থেকে বিতর্কিত কাঠামোর দিকে বন্য বাইসনের মতো ধেয়ে আসছেন করসেবকরা। শুরু হল ইতিউতি দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের উপরে ইটবৃষ্টি। পাশে তাকিয়ে দেখি শুধু দাঁড়িয়ে ‘সানডে মেল’-এর সীতা সিদ্ধার্থন। ডান পাশে গম্বুজের মাথায় সেই অন্ধ্রবাহিনীর দুই প্রতিনিধি। যেন এভারেস্টের মাথায় এডমণ্ড হিলারি- তেনজিং নোরগে!
পরিস্থিতি সামাল দিতে করসেবাস্থলে এলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ অশোক সিঙ্ঘল। তবে পরিস্থিতি তখন হাতের বাইরে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা করসেবকদের থামাতে সিঙ্ঘল কংক্রিট প্ল্যাটফর্মের উপর দু’দিকে দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু বাগ মানল না কেউ। উল্টে গালাগাল করতে করতে তাঁর পাশ দিয়ে মসজিদ ভাঙতে পাগলের মতো দৌড়তে লাগল মানুষ। সিঙ্ঘল অসহায় ভাবে মারমুখী জনতার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ধ্বস্তাধ্বস্তিতে তখন তাঁর ধুতির কাছা খুলে গিয়েছে। কোনদিকে যাব বুঝতে পারছিলাম না। তারপর কী ভেবে করসেবকদের সঙ্গে দৌড়ে গেলাম বিতর্কিত কাঠামোর মধ্যে। এসএসপি ডি বি রাই কাঁদানে গ্যাস চার্জ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু কাঁদানে গ্যাস ছুড়বে য়ারা, উত্তরপ্রদেশের সেই বাহিনী তখন নির্দেশ উপেক্ষা করে চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
গোটা কাঠামো তখন করসেবকদের দখলে। পাঁচিলের উপর, কাঠামোর ছাদে, গম্বুজে থিক থিক করছে করসেবক। ধাক্কাধাক্কিতে কেউ কেউ উপর থেকে ছিটকে এসে পড়ছে নীচের বাঁধানো চাতালে। শুরু হয়ে গিয়েছে ইটবৃষ্টি। শেষ ভরসা সিআরপিএফ-ও বেতের ঢালে মাথা ঢেকে ছেড়ে যাচ্ছে গোটা চত্বর। এক জওয়ান পরামর্শ দিলেন, ‘‘আপ ভি চলো, নেহি তো মর যাওগে।’’ তাঁর ঢালে মাথা বাঁচিয়ে নেমে এলাম সীতা রসুইয়ের সামনের রাস্তায়।
সহকর্মী সাংবাদিকরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে। প্রাক্-মোবাইল যুগ। যোগাযোগের কোনও সুযোগ নেই। উপরে তাকিয়ে দেখলাম মানস কুঞ্জের ছাদের প্রেস গ্যালারিতে থিকথিকে মাথা। গম্বুজ ভাঙার কাজ তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। কংক্রিট নয়, চুন-সুরকির শক্ত ৫০০ বছরের পুরনো গাঁথনির গম্বুজ। ২০ ইঞ্চি চওড়া দেওয়াল অবশ্য মূলত মাটি দিয়েই গাঁথা। গম্বুজ কব্জা করতে না পেরে করসেবকদের লক্ষ্য তখন ছাদ ও গম্বুজের জোড়। পাশাপাশি দেওয়াল ভাঙা।
ঠিক সাড়ে ১২টায় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বাঁদিকের প্রথম গম্বুজটি। মির বাকির গড়া ‘বাবরি মসজিদ’ ধুলোয় মিশে যাওয়ার তখন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
রাম দিওয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ধ্বংসলীলা দেখছি। মাথায় বাঁধা গেরুয়া ফেট্টি। কিন্তু কপালে মেটে সিঁদুরের টিপ আর মাথায় ‘জয় শ্রীরাম’ ফেট্টি থাকলেই যে করসেবকের ছদ্মবেশ ধরা যায় না, তা বুঝলাম বাঁশ হাতে এক করসেবকের তাড়া খেয়ে। চেনা জায়গা। এ গলি, সে গলি ঘুরে ফিরে এলাম উত্তর-পূর্ব গেটের কাছে। ফের তাড়া। চেনামুখের রাগী যুবক বান্টি, ‘‘দাদা ভাগিয়ে হিঁয়াসে। নেহি তো অনর্থ হো যায়গা।’’
মির বাকির গড়া ‘বাবরি মসজিদ’ ধুলোয় মিশে যাওয়ার তখন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। ফাইল চিত্র।
ভাবলাম, অনর্থ হতে আর বাকি কী! রামকথা কুঞ্জের মাইক থেকে তখনও ভেসে আসছে নেতাদের আবেদন। শুনতে পাচ্ছি শেষাদ্রি আবেদন করছেন চারটি দক্ষিণী ভাষায়। তার পর হিন্দিতে। যে গম্বুজের মাথায় করসেবকরা তাণ্ডব করছে তার নীচেই বিরাজমান রামলালা। আডবাণী গলা চড়িয়ে স্বীকার করলেন, ‘‘আপনারা যা করছেন তাতে আমাদের হিতে বিপরীত হবে। এটা বলিদান দেওয়ার সময় নয়!’’ অশোক সিঙ্ঘলের গলায় আর্তি, ‘‘আপলোগ সুন রহে হ্যায়, ম্যায় অশোক সিঙ্ঘল বোল রহা হুঁ। অশোক সিঙ্ঘল বোল রহা হুঁ।’’ কিন্তু নেতারা তখন অপ্রাসঙ্গিক। রামকথা কুঞ্জের দিকে এগোনর বৃথা চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিয়েছি। দেখা এক সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, আডবাণী খুবই বিভ্রান্ত। ইস্যু হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে প্রমোদ মহাজন মাথা চাপড়াচ্ছেন। সকলেই আশঙ্কায়, যে কোনও সময় রাজ্যের বিজেপি সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করবে কেন্দ্রের নরসিংহ রাও সরকার। বাকি কাঠামোর সুরক্ষায় ঢোকাবে সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী। কিন্তু কোথায় কী! বেলা ৩টেয় ভেঙে পড়ল দ্বিতীয় গম্বুজ।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর আবার সরব হল মাইক। এ বার ভেসে এল জ্বালাময়ী ভাষণের জন্য বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) সাধ্বী ঋতম্ভরা ও উমা ভারতীয় গলা। এতক্ষণের ‘স্টান্স’ পাল্টে ফেলে হিন্দুত্ববাদী নেতানেত্রীরা এ বার স্লোগান তুললেন, ‘‘এক ধাক্কা অওর দো। বাবরি মসজিদ তোড় দো।’’ নেতারা ভেসে গেলেন ক্যাডারদের স্রোতে। উঠলাম বিতর্কিত কাঠামোর ঠিক পাশের বাড়ি, সীতা রসুই ভবনের ছাদে। রামভক্তদের বিশ্বাস, এখানেই ছিল সীতামাইয়ার রন্ধনশালা। দেখা কয়েকজন সহকর্মী সাংবাদিকের সঙ্গে। অনেকেই তখন অযোধ্যা ছেড়ে ফৈজাবাদের পথ ধরেছেন। কিন্তু আমি ঠিক করেছি, শেষ গম্বুজটা ভেঙে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব।
শীতের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। বিকেল ৪টে ৪৯ মিনিটে ভেঙে পড়ল মূল গম্বুজ। মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। ভাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই ভাবতে পারছি না। সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি। খিদের বোধও চলে গিয়েছে।
বিজয়োল্লাস। ফাইল চিত্র।
নেমে এলাম সীতা রসুইয়ের তিনতলার ছাদ থেকে। চারদিকে থিক থিক করছে করসেবক। কেউ বিতর্কিত কাঠামোর ইট সংগ্রহ করছে। কয়েকজন সহকর্মীও ইট নিলেন। স্মারক। আমি নিতে গিয়েও নিলাম না। সব গাড়ি পালিয়েছে ফৈজাবাদে। আমাদের গাড়িও। আমার দুরবস্থা দেখে স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রের ‘বহেনজি বাহিনী’ ডাক দিল, ‘‘দেবু ভাইয়া, হমারা গাড়ি মে আইয়ে।’’ মারুতি ওমনি ভ্যানের ভিতরে ঠাসাঠাসি করে বসে বাহিনী। আমি বসলাম পিছনের ডিকিতে। স্টেপনির উপর। পকেটের সিগারেট কখন শেষ হয়ে গিয়েছে। মুখে ড্রাইভারের কাছে চেয়ে নেওয়া বিড়ি। দরজা খোলা। রাস্তার এপাশে-ওপাশে টায়ার জ্বলছে। কোথাও দোকান জ্বলছে। গলির মুখে ভয়ার্ত মুখের জটলা।
কপি ভাবার চেষ্টা করছিলাম প্রাণপণে। এত ঘটনা! কী লিখব? কেমন করে লিখব? ইন্ট্রো কী হবে? মাথাটা বেবাক ফাঁকা!
(লেখক বর্ষীয়ান সাংবাদিক। ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রত্যক্ষদর্শী)