অযোধ্যা মামলার রায় ঘোষণার পরে নির্মোহী আখড়ার সদস্যদের উদ্যাপন। শনিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: প্রেম সিংহ
‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’— করসেবকদের স্লোগানই সত্যি হল। অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতেই তৈরি হতে চলেছে রামমন্দির। যে ২.৭৭ একর জমিতে ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বরের আগে পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল সাড়ে চারশো বছরের বেশি পুরনো বাবরি মসজিদ।
আজ প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ রায় দিয়েছে, মুসলিমদের জন্য মসজিদ তৈরি করতে অযোধ্যাতেই অন্যত্র ৫ একর জমি দেবে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার। যে জমিতে বাবরি মসজিদ ছিল, সেখানে রামমন্দির তৈরির জন্য কেন্দ্র একটি প্রকল্প তৈরি করবে। সেই প্রকল্পে মন্দির তৈরি ও তার পরিচালনার জন্য তিন মাসের মধ্যে একটি ট্রাস্ট ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিচারপতিরা সর্বসম্মত হয়ে এই রায় দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট প্রথমেই বলেছিল, এই মামলাকে শুধু জমি বিবাদ হিসেবে দেখা হবে। আজ ১,০৪৫ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়েছে, আদালত বিশ্বাস বা আস্থার ভিত্তিতে জমির মালিকানা ঠিক করে না। প্রমাণের ভিত্তিতে ঠিক করে। কিন্তু রায়ের পরে প্রশ্ন উঠেছে, সুপ্রিম কোর্ট কি তথ্যের থেকে বিশ্বাসকেই বেশি গুরুত্ব দিল?
রায়ে বলা হয়েছে, অযোধ্যার ওই জমিকে হিন্দুরা যে রাম জন্মভূমি বলে বিশ্বাস করে, তাতে সংশয় নেই। এর মধ্যে কোনও ভণ্ডামি নেই। মুসলিমরাও এই বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। হিন্দুদের পক্ষে রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-এর রিপোর্টেও ভরসা করেছে। যে রিপোর্ট বলেছিল, বাবরি মসজিদের নীচে অ-মুসলিম কাঠামো ছিল। যদিও সেটা মন্দির কি না, সেটা এএসআই নির্দিষ্ট ভাবে জানায়নি বলে আদালতই মেনে নিয়েছে। এমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসির মন্তব্য, ‘‘আজকের রায়ে তথ্যপ্রমাণকে হারিয়ে আস্থা-বিশ্বাসের জয় হয়েছে।’’
সুপ্রিম কোর্ট এ কথাও মেনে নিয়েছে যে, ১৯৪৯ সালে বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের নীচে গোপনে রামের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে মসজিদ অপবিত্র করা ও মুসলিমদের হটানো আইনসঙ্গত হয়নি। ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙাকেও ‘আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে তারা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্কিত জমিতে মসজিদ থাকলেও কি আজ ওই জমি মন্দিরের জন্য দেওয়া হত! প্রবীণ আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেবের প্রশ্ন, ‘‘১৯৪৯ ও ১৯৯২-এ অপরাধ হয়ে থাকলে সে ক্ষেত্রে আদালত কি ন্যায় দিল?’’
অযোধ্যা রায়
• অযোধ্যার বিতর্কিত ২.৭৭ একর ভূমি হিন্দুরাই পাবেন। সেখানে তৈরি হবে রামমন্দির
• কেন্দ্র ৩ মাসের মধ্যে মন্দির তৈরির প্রকল্প তৈরি করবে। মন্দির তৈরি পরিচালনার জন্য ট্রাস্ট ও ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজ’ গঠন করা হবে
• বাবরি মসজিদের ভিতরের ও বাইরের চত্বর পাবে ট্রাস্ট
• ১৯৯৩-এ বিতর্কিত জমি ঘিরে কেন্দ্র বাড়তি প্রায় ৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। কেন্দ্র চাইলে সেই জমিও মন্দির প্রকল্পের জন্য ট্রাস্টকে দিতে পারে
• মসজিদ তৈরির জন্য অযোধ্যাতেই ৫ একর বিকল্প জমি দেওয়া হবে। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার উপযুক্ত ও চোখে পড়ার মতো জায়গায় জমি দেবে
• বাবরি মসজিদের ভিতরের চত্বর যে শুধু তাঁদের দখলেই ছিল, তা মুসলিমরা প্রমাণ করতে পারেননি। বাইরের চত্বর পুরোপুরি হিন্দুদের দখলে ছিল
• ইলাহাবাদ হাইকোর্ট অযোধ্যার জমিকে রামলালা বিরাজমান, নির্মোহী আখড়া ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে ভাগ করে দিতে বলেছিল। ওই সিদ্ধান্ত আইনত টেকে না
• বাবরি মসজিদের নীচে পুরনো কাঠামো ছিল বলে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের রিপোর্টকে ‘আন্দাজ’ বলে খারিজ করা যায় না। তা ইসলামি কাঠামো নয় তবে মাটির নীচের কাঠামো নির্দিষ্ট মন্দির ছিল, রিপোর্টে সে কথাও বলা নেই
• সেবায়েত হিসেবে নির্মোহী আখড়ার দাবি খারিজ। তবে আখড়াকে ট্রাস্টে নিতে পারে কেন্দ্র।
• রামলালা বিরাজমানের মামলাই সমর্থনযোগ্য। রামলালা আইনসিদ্ধ ‘ব্যক্তি’। তবে রাম জন্মভূমি আইনসিদ্ধ ‘ব্যক্তি’ নয়।
আজকের রায়ে রামমন্দির তৈরির দায়িত্ব কার্যত নরেন্দ্র মোদী সরকারের হাতেই তুলে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। কিন্তু আইনজীবীরা বলছেন, রামমন্দির আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যারা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, সেই বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও রাম জন্মভূমি ন্যাসের হাতেই জমি তুলে দিল সুপ্রিম কোর্ট।
কী ভাবে?
সুপ্রিম কোর্টের সামনে মূলত চারটি পক্ষ ছিল। এক, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। মসজিদ তৈরির জন্য যাদের অযোধ্যায় বিকল্প জমি দেওয়া হবে। দুই, নির্মোহী আখড়া। সেবায়েত হিসেবে যাদের অধিকার খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তিন, গোপাল সিংহ বিশারদ। যিনি ১৯৫০-এ প্রথম রাম জন্মভূমিতে পুজোর অধিকার চেয়ে মামলা করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট আজ তাঁর পুজোর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তিনি ১৯৮৬-তেই মারা গিয়েছেন। চার, রামলালা বিরাজমান। যার পিছনে আদতে রয়েছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা এবং তাঁদের তৈরি রাম জন্মভূমি ন্যাস। আজ সুপ্রিম কোর্ট রামলালা বিরাজমানের দাবিকেই ‘সমর্থনযোগ্য’ বলে তাঁর জন্য জমি ছেড়ে দিয়েছে। যার অর্থ, যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদ ভাঙায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল, তাদেরই জমির অধিকার দেওয়া হল। ট্রাস্ট তৈরি হলেও সেখানে বিজেপি ও সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই থাকবেন, তাতে সংশয় নেই। ওয়াইসির প্রশ্ন, ‘‘সঙ্ঘের লোকেরা দেশের আরও অনেক মসজিদের জমি দাবি করেছে। এ বার কি তারা সেখানে এই রায় তুলে ধরবে?’’
বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ
• ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙা ‘আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন’ ছিল।
১৯৪৯-এর ২২ ডিসেম্বর রাতে মসজিদের মূল গম্বুজের নিচে রামের মূর্তি প্রতিষ্ঠা, তার পরে মসজিদ অপবিত্র করা এবং মুসলিমদের হটানো আইন মেনে হয়নি। ৪৫০ বছরের বেশি পুরনো মসজিদ থেকে মুসলিমদের অন্যায় ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে।
• মুসলিমদের জন্য জমি বরাদ্দ করা জরুরি, কারণ মসজিদে হিন্দু মূর্তি বসিয়ে তা অপবিত্র করা হয়েছিল। আইনি সংস্থা মুসলিমদের হটায়নি। বরং মুসলিমদের প্রার্থনার স্থান থেকে সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল।
• মুসলিমদের অধিকার না দেখলে সুবিচার হবে না। যদিও বিতর্কিত জমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুদের পেশ করা প্রমাণ অনেক শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
• সংবিধান সব রকম বিশ্বাসের সাম্যের দাবি করে। সহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে আরও শক্তিশালী করবে।
• আইনকে ইতিহাস, মতাদর্শ ও ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে দাঁড়াতে হবে।
• জমির মালিকানা আদালত বিশ্বাস বা আস্থার ভিত্তিতে ঠিক করে না, প্রমাণের ভিত্তিতে ঠিক করে।
• মসজিদের বাইরের চত্বরে হিন্দুদের পুজো লাগাতার চলেছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
• মসজিদ তৈরি থেকে ১৮৫৭-য় ব্রিটিশদের অবধ দখল পর্যন্ত মসজিদের ভিতরের চত্বর শুধু তাদের দখলে ছিল, এমন প্রমাণ মুসলিমেরা দেখাতে পারেননি।
আজ সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলেছে, মুসলিমদের প্রার্থনার স্থান বাবরি মসজিদ থেকে সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। যা ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হওয়া উচিত হয়নি। তাই মুসলিমদের অধিকারের বিষয়টি না দেখলে সুবিচার হবে না। এই যুক্তিতেই অযোধ্যার অন্য কোথাও মসজিদ তৈরি করতে ৫ একর জমি বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আরএসএস নেতারা অবশ্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, অযোধ্যা মানে এখন আর ছোট্ট শহর নয়। গোটা ফৈজাবাদ জেলার নামই অযোধ্যা হয়ে গিয়েছে। ফলে জেলার যে কোনও জায়গায় জমি দেওয়া যেতে পারে।
কোন যুক্তিতে অযোধ্যার জমি হিন্দুদের হাতে দেওয়া হল?
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, হিন্দুরা লাগাতার মসজিদের বাইরের জমিতে পুজো করেছে, তার প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু ১৮৫৭-র আগে সেখানে মুসলিমদের নমাজের প্রমাণ মেলেনি। তাই সম্ভাবনার ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে বলা যায়, মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুদের প্রমাণ অনেক মজবুত। অথচ, যে নির্মোহী আখড়া মসজিদের বাইরের জমিতে রাম চবুতরা গড়ে লাগাতার পুজো চালিয়ে গিয়েছিল, সেবায়েত হিসেবে তাদের দাবিই আজ খারিজ করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
আদালত এও বলেছে যে, ১৯৪৯-এর ২২ ডিসেম্বর রাতে পরিকল্পিত ভাবে গোপনে হিন্দু মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে মসজিদ অপবিত্র করা হয়। মসজিদ থেকে মুসলিমদের হঠানো হয়। ৪৫০ বছরের বেশি পুরনো মসজিদে প্রার্থনার অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর মসজিদে শেষ নমাজ হয়েছিল। অর্থাৎ ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত যে মুসলিমরা সেখানে প্রার্থনা করতেন, তা আদালত মেনে নিয়েছে।
ইলাহাবাদ হাইকোর্ট ২০১০-এ অযোধ্যার জমিকে রামলালা বিরাজমান, নির্মোহী আখড়া ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের মধ্যে তিন ভাগে ভাগ করে দিতে বলেছিল। সুপ্রিম কোর্টের মতে, ওই রায় আইনত টেকে না। সামাজিক শান্তি রক্ষার পক্ষেও ওই সমাধান বাস্তবসম্মত নয়। এতে কোনও পক্ষেরই স্বার্থরক্ষা হয় না।