হনুমানগড়িতে গ্রাহকদের অপেক্ষায় দোকানিরা। ছবি: পিটিআই।
রাম জন্মভূমির জায়গা দেখানো সাইনবোর্ড নয়। মাছি গলতে না-পারা নিরাপত্তা নয়। জীবনে প্রথম বার অযোধ্যা এসে মনে সব থেকে বেশি দাগ কেটে গেল আফিম কোঠি!
কোনওক্রমে টিকিট পাওয়া বিমানের চাকা যখন শনিবার লখনউয়ের মাটি ছুঁল, তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশটা ছুঁই-ছুঁই। বিমানবন্দরেও সমস্ত উদগ্রীব চোখ টিভির পর্দায়। রায় কী হল? সঙ্গে চাপা আতঙ্ক, এই টানটান নিরাপত্তার ফাঁক গলেও গন্ডগোল বাধবে না তো? কিছু দিন আগে এই দেশই না রাতের ঘুম শিকেয় তুলে টিভির সামনে বসেছিল ইসরোর পাঠানো চন্দ্রযানের চাঁদের মাটি ছোঁয়া দেখবে বলে!
লখনউ থেকে গাড়ি যত অযোধ্যার দিকে এগিয়েছে, তত বেড়েছে ব্যারিকেড। ডিকি খুলে পুলিশি তল্লাশি। রাস্তায় লোকজন বেশ কম। স্বাভাবিক। কিন্তু হাইওয়ের ঠিক পাশের মুসলিম মহল্লা একেবারে খাঁ খাঁ। প্রায় সমস্ত দোকানের শাটার বন্ধ। নাম প্রকাশে নারাজ এক জন বললেন, পরিবারকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন বেশির ভাগ জনই। এই ভারতই হল ভরিয়ে শাহরুখ-আমির-সলমন খানের সিনেমা দেখে। মহম্মদ শামি উইকেট পেলে লাফিয়ে ওঠে সোফা থেকে! আবার অনুষ্কাকে লুকিয়ে হিংসে করে বিরাট কোহলির ‘প্রেমে পাগল’ মুর্তজা। কোনটা তবে আসল ভারত?
এক লহমায় যেন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল অযোধ্যার আফিম কোঠি। যে দিক দিয়েই গাড়ি বাবরি মসজিদ চত্বরের দিকে এগোতে চায়, সে দিকেই রাস্তা বন্ধ। পুলিশের ব্যারিকেড। আধা সেনার উঁচিয়ে থাকা রাইফেল। মাথার উপরে চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টারও। ফাঁক খুঁজতে এগোচ্ছি ‘চোদ্দ ক্রোশ পরিক্রমা’র রাস্তা ধরে। যা বেয়ে বছরে এক বার ১৪ ক্রোশ হেঁটে অযোধ্যা আর তার লাগোয়া ফৈজাবাদ শহর প্রদক্ষিণ করেন পুণ্যার্থীরা। সেখানেই চোখ টানে ভাঙাচোরা এই পেল্লায় বাড়ি।
এ অঞ্চলে প্রায় পঞ্চাশ বছর কাটানো হরিশঙ্কর, রাজকুমারদের দাবি, এই আফিম কোঠি নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার আমলের। বছর কয়েক আগে পর্যন্তও আফিমের অবাধ ব্যবসা চলেছে এই পোড়ো ইমারত থেকে। এখন? চোখ টিপে উত্তর আসে, “ওর থেকে অনেক কড়া নেশা অযোধ্যার ভাঁড়ারে আছে।” ধর্ম? আর উত্তর নেই।
কিছু দিন আগেও ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের পরে সেনায় থিকথিক করা কাশ্মীরকে টিভির পর্দায় দেখে অনেকেরই হয়তো মনে হয়েছিল, পাকিস্তানের গা-ঘেঁষে থাকা ভারত থেকে ছিটকে বেরোতে চাওয়া একটা রাজ্যকে ধরে রাখতে গেলে বন্দুক, সাঁজোয়া গাড়ি তো লাগবেই। কিন্তু এ দিন বার বার মনে হল, এত অস্ত্র, পুলিশ, সেনা কিসের জন্য? আফিমের নেশাও এত জোরালো কি?
রামনগরীতে ঘোরার সময়ে দেখা হল মহন্ত রাম সেবক দাস, সিয়া রাম দাস, কমলা মহারাজ, অশোক পাণ্ডেদের সঙ্গে। এঁদের অনেকেই গর্বের সঙ্গে বললেন, “কর সেবায় যুক্ত ছিলাম। শামিল ছিলাম মসজিদ ভাঙায়। আজ বড় আনন্দের দিন। বহু প্রতীক্ষার পরে সুখবর এল।” সঙ্গী চালক পাপ্পু যাদব অবশ্য বলছিলেন, “রাম জন্মভূমিতে রাম মন্দির হবে, ভাল কথা। কিন্তু অন্যের প্রার্থনাস্থল ভেঙে এত উচ্ছ্বাস মানায় কি? নাকি মোগল সম্রাট বাবর মন্দির ভেঙে থাকলে, তা শোধ দেওয়ার ভার আমাদের?
তবে দিনের শেষে হনুমান গড়ির সামনে গাঁদার মালা বিক্রি করা অমিত সিংহ, রাধে মোহন কিংবা বিভিন্ন দেবতার রকমারি মূর্তির দোকানি আমন গুপ্ত অথবা খেলনা আর ইমিটেশনের বিপণি সাজিয়ে বসে থাকা প্রহ্লাদ গুপ্ত—প্রায় সকলেরই আশা, এই রায়ে অন্তত দাঁড়ি পড়বে রোজকার চোরা উত্তেজনায়। পর্যটনে জোর দেবে সরকার। বাড়বে বিক্রিবাটা। যাক, মন্দির বনাম মসজিদের আইনি লড়াইয়ের রায়ের আগে যেখানে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে, সেখানেও মানুষ তা হলে পেটের কথা ভাবে।
ফিরতে ফিরতে আবার দেখলাম, মোটরবাইকে স্থানীয়রা ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও আটকে দিচ্ছে পুলিশ। কিন্তু কেউ আনতে যাচ্ছেন ওষুধ, কেউ হয়তো বাড়ি ফিরছেন। তাঁকে তখন দেখাতে হচ্ছে আধার কার্ড। মাঝেমধ্যে দেহতল্লাশি। লোকে বিরক্ত। দেখে মনে হচ্ছিল, মোটে তো এক দিন। তা-ও মাপে অনেক কম। রোজ এমন চেকিংয়ের দমবন্ধ পরিবেশে কাশ্মীর তা হলে বেঁচে আছে কী ভাবে? ফেরার সময়ে আর আফিম কুঠির গা ঘেঁষা রাস্তা ধরে ফিরিনি।