নয়াদিল্লিতে কংগ্রেস সদর দফতরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি রাহুল গাঁধী। ছবি: পিটিআই।
ঘটনাচক্রে এক বছর আগে ঠিক এই তারিখেই কংগ্রেস সভাপতি পদে রাহুল গাঁধীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচনের কথা ঘোষিত হয়েছিল। সেই তারিখটা যদি রাহুলের রাজনৈতিক জীবনে একটা মাইলফলক হয়, তা হলে এক বছর পরের এই তারিখটা আরও বড় মোড়। কংগ্রেসের নেতৃত্ব রাহুলের হাতে আসার পরে এই প্রথম বার বিজেপি-কে এত বড় ধাক্কা দিতে পারল ভারতের ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’। ধাক্কাটা দিতে পারল এমনই একটা সময়ে, যখন ভারত দখলের প্রস্তুতি সব শিবিরেই তুঙ্গে, যখন জাতীয় রাজনীতির সমীকরণ বদলে দেওয়ার খেলা একেবারে ক্লাইম্যাক্সে।
জাতীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একটা ইনিংস খেলার পরে রাহুল গাঁধী কিন্তু অনেকটা সংযত মঙ্গলবার। এক টানা ক্লান্তিকর নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন দৃঢ় চোয়াল এবং নরেন্দ্র মোদীর উপরে বেজায় খাপ্পা হয়ে থাকা যে রাহুল গাঁধীকে দেখা যাচ্ছিল, এ দিন নয়াদিল্লির কংগ্রেস সদর দফতরে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে কিন্তু তাঁকে সেই মেজাজে দেখা যায়নি। জয়ের প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে রাহুল প্রথমেই ধন্যবাদ জানান কংগ্রেস কর্মীদের। তার পরেই নিখাদ সৌজন্যের প্রকাশ। রাহুল বলেন, ‘‘রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে বিজেপি-কে আমরা হারিয়েছি। ওই তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের কার্যকালের মেয়াদে রাজ্যগুলির জন্য যে কাজ করেছেন, তার জন্য আমি তাঁদের ধন্যবাদ দেব। কিন্তু এখন পরিবর্তনের সময়। তাই এ বার ওই কাজ আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব।’’
২০১৭-র গোড়ায় উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, গোয়া ও মণিপুর বিধানসভার নির্বাচন। প্রথম বার সনিয়া গাঁধীর বদলে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রচারের দায়িত্ব চাপল রাহুলের উপর। পঞ্জাবে ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা অকালি-বিজেপি সরকারের নিশ্চিত পতনের গায়ে নিজের সাফল্যের স্টিকার লাগানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি রাহুল সে বার। উত্তরপ্রদেশের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে রাহুল গাঁধীর কংগ্রেসের জোট সুপারফ্লপ হয়। উত্তরাখণ্ডে বড়সড় গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় ফেরে। গোয়া এবং মণিপুরের ক্ষমতাও কংগ্রেসের থেকে ছিনিয়ে নেয় বিজেপি।
আরও পড়ুন: বিজেপির বড় ধাক্কা, রাহুলের হাসি চওড়া করল গোবলয়ের তিন রাজ্য
২০১৭-র শেষ দিকে হিমাচল প্রদেশ এবং গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনেও রাহুলই ছিলেন কংগ্রেসের সারথি। গুজরাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীনই রাহুল নির্বাচিত হয়েছিলেন কংগ্রেস সভাপতি পদে। কিন্তু সে দফাতেও বিজেপির দুর্গে ধস নামাতে পারেনি রাহুলের দল। কর্নাটকে বিজেপি-কে ক্ষমতায় আসতে কংগ্রেস দেয়নি বটে, তবে সে রাজ্যে বিজেপির একক বৃহত্তম দল হয়ে ওঠা আটকাতে পারেনি রাহুল ব্রিগেড।
আরও পড়ুন: ছত্তীসগঢ়ে রমনের ‘উন্নয়ন’-এর রথ আটকে দিল কংগ্রেস
২০১৮-র শেষ প্রান্তে পৌঁছে পাঁচ রাজ্যের এই বিধানসভা নির্বাচনই তাই প্রথম ভোটযুদ্ধ, যেখানে রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সাদা চোখেই অনেকটা পিছনে ফেলে দিল বিজেপি-কে। ২০১৪ সালে ভারতের যে অংশ থেকে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়ে ভারতের লোকসভায় প্রথম বারের জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল বিজেপি একাই, সেই হিন্দি বলয়ের তিনটে রাজ্যে বিজেপির দুর্গে বড়সড় ধস নামিয়ে দিতে পারা তাই রাহুল গাঁধীর কাছে অত্যন্ত বড় রাজনৈতিক প্রাপ্তি।
পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের এই ফল রাহুল গাঁধীকে অনেকটা স্বস্তি তো দিলই। নরেন্দ্র মোদীর ছুড়ে দেওয়া ‘পঞ্জাব, পুদুচেরি আর পরিবার’ (পিপিপি) কটাক্ষকে নস্যাৎও করল। সর্বোপরি দরজায় কড়া নাড়তে থাকা লোকসভা নির্বাচনের আগে বুক ভরে অক্সিজেন নেওয়ার মতো বেশ কিছুটা জায়গা কংগ্রেস পেয়ে গেল। দেশজোড়া সাধারণ নির্বাচনের মতো বড় দৌড়ে সেই অক্সিজেন খুব কাজে লাগবে কংগ্রেসের।
আরও পড়ুন: টিআরএস ঝড়ে উড়ে গেল কংগ্রেস-টিডিপি জোট, দাগই কাটল না বিজেপি
যে অবস্থায় কংগ্রেসের হাল ধরতে হয়েছিল রাহুল গাঁধীকে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কংগ্রেস কখনও ততটা দুর্বল হয়নি। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বেনজির ভাবে ধরাশায়ী হওয়া। তার পর থেকে দেশের প্রায় প্রত্যেকটা প্রান্তে ভরাডুবির সম্মুখীন হওয়া। এমন একটা পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের দায়িত্ব নিয়ে বিজেপি-কে প্রথম বার বড় ধাক্কাটা দিতে রাহুল গাঁধীকে অনেকগুলো নির্বাচন পেরিয়ে আসতে হল ঠিকই। কিন্তু এই পথটা পেরিয়ে আসতে রাহুল গাঁধী যে সময়টা নিলেন, তা হল এক বছর। জরাজীর্ণ, হতোদ্যম কংগ্রেসকে ঘুরিয়ে দাঁড় করানোর জন্য এক বছর সময়টা কিন্তু মোটেই খুব বেশি নয়। স্বাভাবিক ভাবেই রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাবর্ধক স্লোগান আরও চড়া স্বরে শোনা যেতে শুরু করেছে কংগ্রেসের বিভিন্ন দফতরে।
কংগ্রেস সভাপতির বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও দ্রুত পরিবর্তন। দিনভর টানটান উত্তেজনার ভোট গণনা শেষে সন্ধ্যায় যে রাহুল গাঁধীকে দেখা গেল ২৪ নম্বর আকবর রোডের দফতরে, তিনি অনেক বেশি প্রত্যয়ী, অনেক চাপমুক্ত, কথাবার্তায় অনেক বেশি সুবিন্যস্ত। এক বছর নয়, সভাপতি হওয়ার পরে অনেকটা পথ যেন অতিক্রম করে এসেছেন এই রাহুল। জনতা জনার্দনের সাধনায় মোক্ষলাভের আশা নিয়ে সুবিশাল ভারতভূমির প্রান্তে প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে এবং বার বার প্রত্যাখ্যাত হতে হতে এই রাহুল যেন অনেক বেশি পোড় খাওয়া। কিন্তু সেই পোড় খাওয়া মুখটা কোথাও যেন সুপ্ত ছিল, প্রকাশ পেল সাফল্যের প্রথম আস্বাদনেই, প্রকাশ পেল মোক্ষ লাভের পথে কিছুটা এগোতে পারার আভাস পেয়েই।
ইতিহাসের পাতায় আজকের তারিখ, দেখতে ক্লিক করুন — ফিরে দেখা এই দিন।