নিজের ফার্মহাউসে কেসিআর।—ফাইল চিত্র।
ঠিক ৯ বছর আগের একটা দিনকে মনে করিয়ে দিলেন বি সাইলু। বয়স বছর ষাটেক হবে। টান টান চেহারা। কালো মুখে দিন কয়েক ব্লেডের ছোঁয়া পড়েনি। পরনে খাটো ধুতি আর ফতুয়া। চাষবাস করেই দিন কাটে। গত সাড়ে চার বছর কেমন কাটাল গজওয়েল, তা নিয়েই কথা হচ্ছিল। হঠাৎ করেই কথার মাঝে বললেন, কেসিআর না জিতলে তিনি আত্মহত্যা করবেন!
বলে কি লোকটা! হতে পারে গজওয়েল বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও (কেসিআর)-এর বিধানসভা কেন্দ্র। হতে পারে গজওয়েল কেসিআরের দল তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস)-র দুর্গ। এটাও হতে পারে গজওয়েলে গত সাড়ে চার বছরে ভাল উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে এক জন মানুষ না জিতলে আত্মহত্যা করতে হবে!
একটা সময় কেসিআরও এমন ছিলেন। সেটা ছিল ২০০৯-এর নভেম্বর। নতুন রাজ্য তেলঙ্গানার দাবিতে আমরণ অনশনে বসেছিলেন তিনি। পৃথক তেলঙ্গানার দাবি না মানলে প্রাণ দিতেও যে তিনি তৈরি, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এবং ১১ দিন পর কেন্দ্রের তরফে প্রতিশ্রুতি মেলায় তিনি অনশন প্রত্যাহার করে নেন। তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল, সেই অনশনে বসার ৯ বছর পূর্তির দিনে তাঁরই বিধানসভা কেন্দ্র গজওয়েলে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ উত্তেজিত ভাবে বলবেন, কেসিআরের জন্য প্রাণ দিতে তিনি অবলীলায় রাজি! যে মানুষটা রাজ্যের জন্য প্রাণ দিতে তৈরি ছিলেন, আজ তাঁর জন্য প্রাণ দেওয়ার কথা ভাবছেন কেউ কেউ!
বি সাইলু।—নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: রাজনীতি আসলে হাজার সম্ভাবনার মিশেল, বোঝাচ্ছে তেলঙ্গানা
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে কেসিআর তেমন আর আসেন না গজওয়েলে। তাঁর হয়ে গোটাটাই সামলান ভাগ্নে হরিশ রাও। এ বারের নির্বাচনটাও তিনি দেখছেন। নিজে পাশের কেন্দ্র সিদ্দিপেট থেকে লড়ছেন। মামার প্রচার থেকে শুরু করে সবটাই সামলাচ্ছেন একা হাতে। সাইলুর গ্রাম পামুলাপারতি-র যুবক কনক রাজ বললেন, ‘‘কেসিআর সশরীরে এলেন কি এলেন না, তাতে কী আসে যায়? গজওয়েল ঘুরে দেখুন। দেখতে পাবেন, সর্বত্রই কেসিআর দাঁড়িয়ে আছেন।’’ গজওয়েলের প্রায় প্রতিটা গ্রাম প্রকাশ্যে যদিও এমন কথাই বলছে।
কী বলছেন তাঁরা? এই চার বছরে প্রতিটা গ্রামে ঘরে ঘরে পাইপের মাধ্যমে জল এসেছে। সব গ্রামে ঝকঝকে তকতকে রাস্তা হয়েছে। বছর দুয়েক ধরে আর লোডশেডিং হয় না। এলাকায় বড়সড় হাসপাতাল হয়েছে। কিন্ডারগার্টেন থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট (কেজি টু পিজি)— একই পরিকাঠোমোয় পড়ার ব্যবস্থা হয়েছে। শুখা মরসুমে চাষের কাজে ব্যবহারের জন্য জলাধার তৈরি হচ্ছে। বার্ধক্য ভাতা মিলছে। চাষযোগ্য জমির মালিক রায়তবন্ধু প্রকল্পে একর প্রতি চার হাজার টাকা করে পাচ্ছেন। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করা পরিবারের মেয়ের বিয়েতে এক লাখ টাকা করে উপহার মিলছে। যাঁদের বাড়ি নেই, তাঁরা দুই কামরার পাকা বাড়ি পাচ্ছেন। আরও অনেক কিছু। আর কী চাই? ভিন্ রাজ্যের সাংবাদিককে পাল্টা প্রশ্ন করলেন প্রেগনাপুরের রেস্তরাঁ ব্যবসায়ী মহম্মদ পারভেজ।
গরিবদের জন্য বাড়ি তৈরি হয়েছে গজওয়েলে।—নিজস্ব চিত্র।
তবে, এই ‘সব পেয়েছি’র গজওয়েলেও কিন্তু অসন্তোষ রয়েছে। যেমন যে জলাধার নিয়ে গজওয়েলের এত গর্ব, সেই কোন্ডাপোচাম্মা তৈরি করতে অন্তত চারটি গ্রাম খালি করে দিতে হয়েছে। সেই গ্রামে ঘড়বাড়ি, স্কুল, চাষের জমি সব ছিল। তার বদলে মিলেছে একর প্রতি ৬ লাখ টাকা। আর একটা করে দু’কামরার বাড়ি। টাকা পেলেও বাড়ি এখনও সকলে পাননি। কালেশ্বরম প্রকল্পের আওতায় রাজ্য জুড়ে বেশ কয়েকটি জলাধার বানানো হচ্ছে।
কোন্ডাপোচাম্মা এখনও নির্মীয়মাণ। হায়দরাবাদ থেকে সিদ্দিপেটের পথে প্রেগনাপুরের আগে ডান দিকে পাকা চওড়া রাস্তা ধরে গেলেই নজরে আসে বড় টিলার মতো একটা অংশ। সেই টিলা বেয়ে উপরে উঠলে বোঝা যায়, জলাধারটা দেখতে একটা বিশাল স্টেডিয়ামের মতো। যার ভিতরে শ-খানেক ইডেন গার্ডেন্স ঢুকে যাবে অনায়াসে। নীচে কাজ চলছে। সেখানেই দেখা হল রঙ্গা রেড্ডির সঙ্গে। দূরে আঙুল উঁচিয়ে দেখানোর চেষ্টা করলেন, কোন জায়গায় তাঁর বাড়িটা ছিল! এখনও থাকার জায়গা পাননি। জমিটা দেওয়ার কোনও ইচ্ছেও ছিল না তাঁর। তা হলে? বৃদ্ধ রঙ্গা বললেন, ‘‘কী করতাম না দিয়ে! সঙ্গে কাউকে পেলাম না। সকলেই তো চাপের মুখে দিয়ে দিল। আর প্রাণের মায়া তো আছে! টাকা পেয়েছি। বাড়ি এখনও পাইনি।’’ রোজই এ পথে অন্যের জমিতে কাজে যাওয়ার সময় এক বার করে মুছে যাওয়া গ্রামটা দেখে যান রঙ্গা।
কোন্ডাপোচাম্মা জলাধার।—নিজস্ব চিত্র।
গজওয়েল ঘুরে বোঝা যায়, কেসিআরের প্রতি ভালবাসা যতটা আছে, ভয়ও আছে ততটাই। আর সেই ভয়কে হাতিয়ার করেই তাঁর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছেন কংগ্রেসের ভি প্রতাপ রেড্ডি। এর আগে ২০১৪ সালেও তিনি কেসিআরের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)-তে। পরে কংগ্রেসে যোগ দেন। এ বার প্রজা কুটামি অর্থাৎ মহাজোটের প্রার্থী হিসাবে লড়ছেন। ইতিমধ্যেই কেসিআরের দলের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করেছেন পুলিশের কাছে। প্রায় মাঝরাতে তাঁর দেখা মিলল গজওয়েল মোড়ে। গোটা দিন বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে ঘুরতে তিনি তখন ক্লান্ত।
নানাবিধ অভিযোগের সঙ্গেই বললেন, ‘‘সিদ্দিপেট থেকে দুষ্কৃতীরা এসে গ্রামের লোককে ভয় দেখাচ্ছে। আমাদের কর্মীকে মারধর করছে। ভয় দেখাচ্ছে। আমাকে পুলিশ দিয়ে হেনস্থা করানো হচ্ছে। অতিষ্ট হয়ে সে দিন তো আমি আত্মহত্যা করব বলে গায়ে পেট্রল ঢেলে দিয়েছিলাম। কর্মী সমর্থকরা ঠেকায়।’’ প্রতাপ আরও জানালেন, গজওয়েলের উন্নয়ন আসলে একটা লোক দেখানো বিষয়। মুখ্যমন্ত্রী যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কোনও কাজই হয়নি। দু’কামরার বাড়ি থেকে সরকারি চাকরি, কোনটাই পায়নি মানুষ। অভিযোগ তুলেই থামলেন না। বললেন, ‘‘এতই যদি উন্নয়ন হবে, তা হলে নিজের কেন্দ্রে প্রচারে আসছেন না কেন কেসিআর? এক দিনের জন্য এসে কেন গজওয়েলের ফার্মহাউসে লুকিয়ে ১০ হাজার মানুষকে ডেকে দাওয়াত দিতে হল?’’
গজওয়েল হাসপাতালে কেসিআর।—ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: ‘চিরশত্রু’কে মিলিয়ে দিয়েছেন মোদী, রাহুল-চন্দ্রবাবু গলাগলিতে অন্যায় দেখছে না ‘প্রজা কুটামি’
রাজ্য রাজনীতির আনাচেকানাচে কান পাতলে শোনা যায়, কেসিআর আসলে রাজ্য গঠনের পর তেলঙ্গানা আন্দোলনের আবেগটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি নিজের এমন একটা ইমেজ তৈরি করে রেখেছেন, যেখানে মনে হয়, ‘জয় তেলঙ্গানা’ নয়, তিনি আসলে ‘জয় কেসিআর’ শুনতে চান।
আর সে কারণেই হয়তো বি সাইলুরা অবলীলায় বলতে পারেন, ‘‘কেসিআর না জিতলে আত্মহত্যা করব।’’