সরকারি ওয়েবসাইটে এনআরসি-র কোনও তথ্য নেই। —ফাইল চিত্র।
সময় লেগেছিল ৬ বছর। খরচ হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। প্রচুর মানুষের হেনস্থা হওয়া এবং মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এ সবের নিটফল কি কার্যত শূন্য হতে বসেছে? প্রশ্নটা উঠছে কারণ, অসমে হওয়া জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)-র সমস্ত তথ্যই সরকারি ওয়েবসাইট থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে। যে ওয়েবসাইটে অসমের এনআরসি সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য দেখা যেত, গত দু’মাস ধরে সেখানে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিরোধীদের দাবি, এনআরসি-র সমস্ত তথ্যই গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, গোটাটাই প্রযুক্তিগত ত্রুটি।
এমনিতেই জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সাম্প্রতিক পরস্পর বিরোধী মন্তব্যে দেশ জুড়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। এরই সঙ্গে বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি (এনপিআর)। এই তিনের জেরে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ। সেই আতঙ্কের আবহে এ বার সরকারি ওয়েবসাইট থেকে অসমের এনআরসি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য উধাও হয়ে গেল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই ওই তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু, গত দু’মাস ধরে তা দেখা যাচ্ছে না। প্রযুক্তিগত কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কিন্তু, এর পিছনে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে বিরোধী শিবির কংগ্রেস। আচমকা সমস্ত তথ্য উবে গেল কী ভাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তারা।
এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় কাদের নাম রয়েছে এবং কাদের বাদ গিয়েছে তা জানতে এত দিন একটি ওয়েবসাইটে (www.nrcassam.nic.in) গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ক্লিক করলেই সে সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য দেখা যেত। কিন্তু ইদানীং ওই ওয়েবসাইটের নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ক্লিক করলে ‘এরর’ দেখাচ্ছে। প্রায় দু’মাস ধরে এই সমস্যা চলছে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ‘উইপ্রো’র সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়াতেই এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে দাবি করেছেন অসমে এনআরসি-র বর্তমান কো-অর্ডিনেটর হিতেশ দেব শর্মা। এই সমস্যার জন্য তাঁর পূর্বসূরি প্রতীক হাজেলাকেই দায়ী করেছেন তিনি। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হিতেশ বলেন, ‘‘গত বছর ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ক্লাউড পরিষেবা এবং ওয়েবসাইট সংক্রান্ত সব কিছুর দায়িত্ব ছিল বেসরকারি সংস্থা উইপ্রোর হাতে। কিন্তু আমার আগে যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি চুক্তি পুনর্নবীকরণ করেননি। সে জন্য গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে ওয়েবসাইটে কোনও তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না।’’ তাঁর দাবি, বিষয়টি নিয়ে উইপ্রোর সঙ্গে নতুন করে কথাবার্তা চলছে এবং খুব শীঘ্রই একটা সুরাহা হবে। হিতেশ বলেন, ‘‘আমি ২৪ ডিসেম্বর দায়িত্ব পেয়েছি। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই এ নিয়ে উইপ্রোকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। ওরা কাজে হাত লাগালেই, ফের সমস্ত তথ্য ওয়েবসাইটে ফিরে আসবে। আগামী দু’-তিন দিনের মধ্যেই তা ফের দেখতে পাবেন সাধারণ মানুষ।’’
আরও পড়ুন: আপ বিধায়কের কনভয়ে গুলি, হত ১, পুলিশ বলছে ‘ব্যক্তিগত শত্রুতা’
সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতেই অসমে এনআরসি হয়েছিল। চূড়ান্ত তালিকায় বাদ পড়েছিল প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের নাম। তার মধ্যে অন্তত ১৩-১৪ লক্ষ হিন্দু। তালিকা প্রকাশ হতেই অস্বস্তিতে পড়ে যায় রাজ্যের শাসক দল বিজেপি। চূড়ান্ত তালিকায় বেশির ভাগ হিন্দুদের নাম বাদ পড়ায় ভোট ব্যাঙ্কে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছিল অসম বিজেপি। এমনকি সঙ্ঘ পরিবারের তরফেও চাপ বাড়ছিল বলে জানা যায়। সেই আবহে গত নভেম্বরে রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়ে দেন, গোটা দেশের সঙ্গেই অসমে নতুন করে এনআরসি হবে। রাজ্য বিজেপিও দাবি তোলে, অসমের এনআরসি পুরোপুরি বাতিল করে সারা দেশের সঙ্গে নতুন করে এনআরসি হোক।
সেই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের যুক্তি ছিল, অসম চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে এনআরসি তৈরির ভিত্তিবর্ষ বলে ধরা হয়েছিল। ভবিষ্যতে দেশের সব রাজ্যে যখন এনআরসি-র কাজ শুরু হবে তখন অতীতের একটি নির্দিষ্ট দিনকে ধরে তার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি হবে। কোন বছরের কোন তারিখের ভিত্তিতে ওই কাজ শুরু হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ ভিত্তিবর্ষ হবে না বলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সূত্র জানায়। কারণ, এক দেশে দু’টি ভিত্তিবর্ষ হতে পারে না। তাই গোটা দেশে যে ভিত্তিবর্ষ ধরা হবে, সেটির হিসাবে অসমেও নতুন তালিকা তৈরি করা হবে। অমিত শাহ সেই কারণেই রাজ্যসভায় ওই মন্তব্য করেছিলেন বলে মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছিল।
সেই সময় বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিল, এনআরসি-তে হিন্দুরা বাদ যাচ্ছে বলে যে প্রচার শুরু হয়েছে তা আটকাতেই ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা জলাঞ্জলি দিতে চান নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা। তাদের আরও প্রশ্ন ছিল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে করা তালিকা এ ভাবে বাতিল করা কি শীর্ষ আদালতের অবমাননা নয়?
আরও পড়ুন: রবিবার শপথ কেজরীবালের, আরও জোরদার বিরোধী ঐক্যের প্রস্তুতি
সেই আবহেই এখন, যখন জানা যাচ্ছে এনআরসির কোনও তথ্যই আর অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন বিরোধীদের প্রশ্ন, ১৬০০ কোটি টাকা খরচ হল, কোটি কোটি মানুষ হয়রান হলেন, বহু আত্মঘাতী হলেন, সেই ক্ষতিপূরণ কে দেবে? বিষয়টিকে একেবারেই হালকা ভাবে নিতে রাজি নয় অসম প্রদেশ কংগ্রেসও। এ নিয়ে ভারত সরকারের রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সেনসাস কমিশনারকে ইতিমধ্যেই অভিযোগপত্র পাঠিয়েছে তারা। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘এনআরসি-র ওয়েবসাইট থেকে আচমকাই সমস্ত তথ্য উড়ে গিয়েছে। তালিকায় কার নাম রয়েছে, কার নাম বাদ গিয়েছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ যাতে সব কিছু হাতের কাছে পান, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টই ওই সমস্ত তথ্য অনলাইন প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছিল। আচমকা সব কিছু কী ভাবে উড়ে গেল, তা রহস্যজনক ঠেকছে।’’
অসম বিধানসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের দেবব্রত সাইকিয়া ওই চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘যাঁদের নাম বাদ গিয়েছে, এখনও তাঁরা নাগরিকত্ব পেতে আবেদনই করে উঠতে পারেননি। তার মধ্যে সমস্ত তথ্য উড়ে যাওয়ার পিছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে।’’