জনজোয়ার: লতাশিলের মাঠে প্রতিবাদীদের সমাবেশ। বৃহস্পতিবার গুয়াহাটিতে। ছবি: সংগৃহীত।
রোজ অফিসে আসার রাস্তা যে এমন রণক্ষেত্রের চেহারা নেবে ভাবিনি। চলছে গুলি, ছোড়া হচ্ছে কাঁদানে গ্যাস। প্রাণভয়ে দৌড়চ্ছেন সকলে।
কাঁধে ক্যামেরা, বুকে প্রেস কার্ড ঝুলিয়ে তা-ও এগোলাম স্কুটারে। গুয়াহাটি ক্লাবের গোল চক্করে রাস্তায় শোয়া এক জন ডাকলেন, ‘‘দাদা, ব্যান্ডেজ বা ফার্স্ট এড আছে?’’ অদূরে আরও একজন পড়ে। স্কুটার হাতড়ে অনেক পুরনো ব্যান্ডেজ পেলাম। রক্তে ভেজা জামা বুকের কাছে তুলে দেখি, পাঁজরের নীচে কাটা, রক্ত জমেছে। সম্ভবত কাঁদানে গ্যাসের শেল সরাসরি লেগেছে। তাঁর সঙ্গীরা তত ক্ষণে চলে এসেছেন। অন্য জনকে স্কুটারে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম আধা খোলা ওষুধের দোকানে। সেখান থেকে উলুবাড়িতে অফিসের দিকে আসতেই দুমদাম শব্দ। আবার দৌড়।
কার্ফু বলবৎ গত রাত থেকেই। মোতায়েন ছিল পুলিশ, আধা সেনা। বড় রাস্তা, পাড়ার মধ্যেও মেশিনগান বসানো সেনা-ট্রাক টহল দিচ্ছে। কিন্তু মুখে ‘জয় আই অসম’ স্লোগান, গলায়-মাথায় অসমের ঐতিহ্য ফুলামো গামোসা পেঁচানো ছাত্রছাত্রীদের দল অকুতোভয়ে মোটরসাইকেলে, হেঁটে রওনা হয়েছিলেন লতাশিলের মাঠে। বিহু, ক্রিকেট আর দুর্গাপুজোর জন্য বিখ্যাত মাঠটাই আজ ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। জনসমুদ্র তো বটেই। কে নেই সেখানে। আসুর নেতা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য, আলফ নেতা অনুপ চেটিয়া, শিল্পী সমাজের নেতা জুবিন গর্গ, অভিনেত্রী বর্ষারানি বিষয়া, আজই সরকারি পদে ইস্তফা দেওয়া নায়ক যতীন বরা, উকিল সংগঠনের নেতা নেকিবুর জামান। মুখ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের আলোচনায় আহ্বান জানালেও তাঁরা প্রস্তাব ফিরিয়ে যোগ দেন সমাবেশে। শান্তিতে, নির্ভীক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নেন সকলে। রব ওঠে, যে ভাবে আজ উড়িয়ে দেওয়া হল কার্ফু, সে ভাবে নস্যাৎ করা হবে বিলও। বাড়ি থেকে তখনই ফোন এল, খাবারে টান পড়েছে। ওষুধও নেই। আচমকা বিক্ষোভ-কার্ফুর জেরে অধিকাংশ বাড়িতেই একই অবস্থা। পিছন থেকে চেনা গলায় ডাক। এক মোটরবাইক কোম্পানির আঞ্চলিক কর্তা মন্টু মেধি ও তাঁর আইনজীবী স্ত্রী। রাজনীতি থেকে শতহস্ত দূরে থাকা ওই দম্পতি ছোট্ট সন্তানকে বাড়িতে রেখে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। হাতে লিখে বিলোচ্ছেন প্ল্যাকার্ড। চিন্তা, ফেরার পথে কিছু খাবার জোগাড় করতেই হবে, অন্তত বাচ্চার জন্য দুধ।
বিক্ষোভকারীদের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক পুলিশের। গুয়াহাটিতে। এপি
মাঠের সামনেই ফ্ল্যাট ঊর্মি ভট্টাচার্যের। বিয়ের পরে বেঙ্গালুরুতে থাকা ঊর্মিদেবী নাচের পরীক্ষা দিতে গুয়াহাটি এসেছেন। মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখ করছিলেন, ‘‘বুঝতে এসেছি ব্যাপারটা কী! নাচের ম্যাডাম, সতীর্থেরা সকলে বিলের নিন্দে করছে, বাঙালিদের প্রতি খড়্গহস্ত। কিন্তু প্রতিবাদ দূরের কথা, বাংলায় কথা বলতেও সংকোচ হচ্ছে।’’
আড়াই ঘণ্টা সমাবেশের পরে ধুলো ওড়ানো ভিড় থেকে স্লোগান ওঠে। মায়ের কোলে বাচ্চার হাতে প্ল্যাকার্ডে ধরা বিদ্রোহ। অশীতিপর বৃদ্ধার হাতে উড়তে থাকে প্রতিবাদ। সে সব পেরিয়ে অফিসের দিকে যেতে উলুবাড়িতে জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধে পড়লাম। পরে প্রতিবাদকারী বাইক-মিছিলের ভিড়ে গিয়ে পার করলাম সেতু। অফিসে কিছু ক্ষণ কাজ করার পরেই অদূরে গুলির শব্দ। ফের বেরোলাম। তিনশো মিটার দূরে লাচিতনগরে হনুমান মন্দিরের সামনে বিক্ষোভকারীদের দলকে হঠাতে পারছিল না পুলিশ।
আর এগোনো গেল না। পুড়ছে একের পর এক গাড়ি। বিক্ষোভনগরী ঢাকছে ধোঁয়ার গন্ধে।