ইন্ডিয়া গেটের সামনে সিএএ-বিরোধী মিছিল। —ফাইল চিত্র।
মুখোশের মিছিল— সদ্য ফেলে আসা উনিশের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল হংকংয়ে। সরকার-বিরোধী আন্দোলনে এই মুখোশই ক্রমশ মিছিলের মুখ হয়ে যাচ্ছে দেখে অক্টোবরে মুখোশ পরে প্রতিবাদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চিনপন্থী ক্যারি ল্যামের প্রশাসন। বলা হয়, মুখে রং মাখাও যাবে না। এ বার সেই মুখোশ আর রঙেরই আমদানির পক্ষে সওয়াল উঠল ভারতের সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে।
বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, কয়েক দিন ধরেই আন্দোলনের লাগাতার ভিডিয়ো-ছবি তুলছে দিল্লি পুলিশ। তার পর ‘অটোমেটেড ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার’ (এএফআরএস) দিয়ে চলছে বিক্ষোভকারীদের চিহ্নিত করার কাজ। নিখোঁজ শিশুদের উদ্ধারে ২০১৮-য় এই সফটওয়্যার হাতে আসে পুলিশের। এ বার তা দিয়েই চলছে ‘প্রতিবাদীর খোঁজ’। অবিকল চিনা ধাঁচে। পুলিশ-প্রশাসনের চোখে ধুলো দিতে হংকংয়ের মতো তাই এখানেও মুখোশ পরে পথে নামার আর্জি জানিয়ে বেশ কয়েকটি পোস্ট ঘোরাফেরা করছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আরও পড়ুন: হস্টেলের বর্ধিত ফি চালু, প্রতিবাদ জেএনইউয়ে
একটি পোস্টে যেমন ডায়াগ্রাম এঁকে বোঝানো হয়েছে, মাথায় টুপি-স্কার্ফ আর মুখে ডাক্তারি কিংবা দূষণ-রোধী মুখোশ পরে কী ভাবে আড়াল করতে হবে নিজেদের। শুধু দিল্লি নয়, সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, হায়দরাবাদ পুলিশকেও ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বিক্ষোভ চলাকালীন ফোন হাতে লাগাতার ভিডিয়ো তুলতে দেখা গিয়েছে। টুইটারে কয়েক জন অভিযোগ জানিয়েছেন, অ্যান্ড্রয়েড ফোনে পথেঘাটেই ‘এএফআরএস’ ব্যবহার করছে পুলিশ।
এই পরিস্থিতিতে তাই মুখোশকেই ঢাল করার কথা বলছেন অনেকে। নজরদারি এড়াতে হংকংয়ে বহু প্রতিবাদীকে ল্যাম্পপোস্টের মাথায় উঠে সিসিটিভি ভাঙতে দেখা গিয়েছিল। কোথাও ছাতা মাথায় আত্মগোপন। মুখোশ নিষিদ্ধ হওয়ার পরে লেজ়ার দিয়ে ক্যামেরা অকেজো করতেও দেখা গিয়েছে হংকংয়ের রাস্তায় রাস্তায়। কিন্তু ভারতে কেন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে নেমে এ ভাবে মুখ লুকোতে হবে— সোশ্যাল মিডিয়ায় সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। উত্তরে এক নেটিজ়েনতেই বলতে শোনা গেল, ‘‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো পোশাক দেখেই সব বুঝে যান। তার পর যদি পুলিশও সফটওয়্যার দিয়ে কারও ঠিকানা-কুষ্ঠি উদ্ধার করে দেয়, তার তো হয়েই গেল!’’
সংসদে নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার পর-পরই দেশের নানা প্রান্তে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। তাকে সমর্থন জানিয়ে অনেকেই টিকটক, টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে আন্দোলনের ছবি, ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন। এ ভাবে অজান্তেই অনেকের মুখ-চোখ হাতে এসে যাওয়ার কথা পুলিশের। সূত্রের খবর, সব মুখ জড়ো করে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোকে দিয়ে বড়সড় ‘ক্রাইম অ্যান্ড ক্রিমিনাল ট্র্যাকিং’ নেটওয়ার্ক তৈরি করছে পুলিশ। তাই মুখোশ পরেও ‘বিপদ’ এড়ানো যাবে কি না, আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন ভাবে গবেষণা করছেন হায়দরাবাদের যুবক শ্রীনিবাস কোদালি। ২৮ ডিসেম্বর তিনি একটি টুইট করে জানান, হায়দরাবাদ পুলিশ তাদের নিজস্ব একটি ফোন-অ্যাপ ব্যবহার করে মিলিয়ে দেখছে মিছিলের কোনও মুখ তাদের ডেটাবেসে আছে কি না। তাঁরও প্রস্তাব, মুখোশ কিংবা মুখে রং মেখে পুলিশ-প্রশাসনের এই অনৈতিক নজরদারি এড়ানো যেতে পারে। ‘‘কিন্তু পুলিশের হাতে থাকা ‘কৃত্রিম মেধা’ যদি কারও হাঁটাচলার ধরন বুঝে নেয়, তা হলে সমূহ বিপদ,’’ মত শ্রীনিবাসের।
ফেস রিকগনিশন পদ্ধতি যে ভাবে কাজ করে, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। তবে পুলিশের হাতে এই হাতিয়ার তুলে দেওয়া নিয়ে শুধু হংকং নয়, আগে প্রতিবাদ হয়েছে রাশিয়াতেও। ব্রিটেনে এখনও মামলা চলছে। কিন্তু রাশিয়ার এক আদালত কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে চায়নি। নিরাপত্তার কথা বলে সফটওয়্যার চালু রেখেছে পুলিশ। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারও একই পথে হাঁটবে, এই আশঙ্কাতেই মুখোশ চেয়ে পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দু’দিন আগে ইন্ডিয়া গেটের এক জমায়েত মিছিলেও সারি-সারি মুখোশ নজরে এসেছে। চোখ-নাক শুধু খোলা, বাকিটা বন্ধ। কারও পুরো সাদা। কারও আবার মুখের ওপর একটা কালো হাত। হাতের উপর পদ্ম ছাপ।