সিএএ নিয়ে ফের পাক তাস খেললেন প্রধানমন্ত্রী

মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁর সরকারের কাজ নিয়ে সব ধরনের বিরোধিতাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলে দাগিয়েছে বিজেপি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা 

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:২২
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।—ছবি পিটিআই।

কপালে চন্দনের প্রলেপ। কাঁধে লাল অঙ্গবস্ত্র। কর্নাটকের শ্রী সিদ্ধগঙ্গা মঠ। সামনে নাবালক সাধুদের জমায়েত।

Advertisement

সেখানে দাঁড়িয়েই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে পথে নামা দল ও সংগঠন এবং পাকিস্তানকে এক মেরুতে এনে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী! কংগ্রেস-সহ বিরোধী শিবিরকে তাঁর ‘পরামর্শ’, ‘‘আন্দোলন করতে হলে পাকিস্তানের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে করুন।’’

মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁর সরকারের কাজ নিয়ে সব ধরনের বিরোধিতাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলে দাগিয়েছে বিজেপি। সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে গোড়ায় একে শুধুমাত্র ‘মুসলিমদের বিক্ষোভ’ হিসেবেই দেখানোর চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু ‘সাফল্য’ মেলেনি।

Advertisement

এই অবস্থায় আজ মোদী দু’টি কৌশল নিয়েছেন। এক, সিএএ-র বিরোধিতাকে ‘সংসদের বিরোধিতা’ বললেন। সিদ্ধগঙ্গা মঠে তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেস, তাদের সহযোগীরা এবং তাদের তৈরি ইকোসিস্টেম দেশের সংসদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।’’ যা শুনে বিরোধীরা বলছেন, ‘এই আন্দোলন সংসদ নয়, মোদীর বিভাজনকারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে।’

আরও পড়ুন: দুই-তৃতীয়াংশ আসন বাংলায়, দাবি অমিতের

দ্বিতীয় কৌশলে প্রধানমন্ত্রী সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে আন্দোলনের মুখ ঘোরাতে চেয়ে পাকিস্তানকে টেনে এনে বলেছেন, সে-দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিরোধীরা মুখ খুলছেন না কেন? মোদীর এই কৌশলকে বিজেপি-সঙ্ঘের মেরুকরণের চেষ্টা বলেই দেখছে বিরোধীরা। মোদী বলেন, ‘‘আন্দোলন করতে হলে গত ৭০ বছরে পাকিস্তানের কুকীর্তির বিরুদ্ধে করুন। স্লোগান দিতে হলে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে দিন। মিছিল করতে হলে পাকিস্তানের দলিত-পীড়িত-শোষিতদের সমর্থনে মিছিল করুন।’’

মোদীর এমন দাওয়াই নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। তাঁরা বলছেন, মোদী সব সময়েই পাকিস্তানের জুজু দেখান। ভোটের সময়েও, বিক্ষোভেও। তাঁদের কটাক্ষ, মোদী শাসনে কৃষি, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য— সব ক্ষেত্রে সমস্যায় ভুগছে দেশ। আর উনি দেশবাসীকে বলছেন, সে-সব নিয়ে কথা না-বলে পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করতে! সিপিএমের পলিটবুরো সদস্য নীলোৎপল বসু বলেন, ‘‘আপনি আচরি ধর্ম...। মোদী নিজে কেন পাকিস্তানের বিষয় নিয়ে আন্দোলন করছেন না? মোদী জমানায় গোটা দেশ যখন সঙ্কটে, তখন প্রতিবেশী দেশের সমস্যা নিয়ে বিরোধীদের আন্দোলন করতে বলা নিয়ে ওঁর জ্ঞান কেউ শুনবে না।’’

আরও পড়ুন: আজাদি! ২৩ দিনকে আগলে ৯১ বছরের স্বর

পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে মোদীর বক্তব্যকে আক্রমণ করেছে নাগরিক সমাজও। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও যুদ্ধ পরিস্থিতি বিষয়ের অধ্যাপক অশোক সোয়াইঁয়ের কটাক্ষ, ‘‘পশ্চিম এশিয়ায় শুধুমাত্র ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায়। আর মোদীর নতুন ভারতে আপনি শুধু মাত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেন।’’ কংগ্রেস বলছে, বছর পাল্টালেও মোদীজির চালাকি পাল্টায়নি। উনি কাউকেই আওয়াজ তুলতে দেবেন না। অন্নদাতা চাষি হোক বা তরুণ প্রজন্ম, বা মহিলা। মোদী যখন পাকিস্তান সম্পর্কে কংগ্রেসের নরম সুর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তখন আচমকা পাকিস্তানে গিয়ে নওয়াজ শরিফের পারিবারিক অনুষ্ঠানে মোদীর হাজির হওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। তুলেছে আম উপহার পাঠানোর কথাও। সেই সঙ্গেই অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের নাম না করে মোদীকে খোঁচা দিয়ে কংগ্রেসের রণদীপ সুরজেওয়ালা বলেন, ‘‘আপনার নিজের দলের মুখ্যমন্ত্রীই তো প্রকাশ্যে সিএএ-র বিরোধিতা করেছেন। ওঁকেও কি দেশদ্রোহী বলবেন?’’

আজ কর্নাটকে গিয়ে সিএএ-বিরোধিতাকে পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে বলেও দেগে দেন মোদী। একই সুরে মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশে অত্যাচারিত সংখ্যালঘুরা ভারতে না এলে কোথায় যাবেন? ইটালিতে?’’ বিরোধীদের পাল্টা যুক্তি, কোনও শরণার্থীকে নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে আপত্তি তোলা হয়নি। ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করা নিয়েই আপত্তি উঠেছে দেশজুড়ে।

তাৎপর্যপূর্ণ হল, প্রধানমন্ত্রী আজ বারবার পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের উপর ধর্মীয় নিপীড়নের কথা বললেও বাংলাদেশে ধর্মীয় নিপীড়ন নিয়ে মুখ খোলেননি। অথচ পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাঁদের মধ্যে মুসলিম ছাড়া বাকিদের নাগরিকত্ব দিতেই সিএএ-র আমদানি। রাজনীতিকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার অসন্তোষ প্রকাশ করাতেই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রসঙ্গে তোলেননি।

সিএএ পাশের পরে তিন সপ্তাহ কাটলেও দেশ জুড়ে প্রতিবাদে ভাটা পড়েনি। বিরোধীদের মতে, তা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা মোদীর বক্তব্যেই স্পষ্ট। মোদীর দু’দিনের কর্নাটকে সফরে সিএএ-র বিরুদ্ধে এবং ফসলের নায্য দামের দাবিতে চাষিরা বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। বিক্ষোভ ঠেকাতে আগেভাগে বেঙ্গালুরু, টুমকুর, শিবামোগ্গায় ধরপাকড় চালায় রাজ্যের বিজেপি সরকার।

সিএএ নিয়ে প্রতিবাদের জেরে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির একাধিক শহরে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। আজ কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘‘২০১৯-এ ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৫৯ দিন প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র বারাণসীতে ১৪৪ ধারা জারি ছিল। তার পরেও ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই বলার মতো তাঁর মুখ রয়েছে?’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement