মণ্ডপ’ শব্দের প্রাকৃত রূপ মাণ্ডু। ক্রমে এই নামেই পরিচিত হয় মধ্যপ্রদেশের মালওয়া প্রদেশের ধার জেলার ঐতিহাসিক শহর। ইনদওর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে বিন্ধ্য পর্বতের খাড়াই ঢাল বেয়ে বিস্তৃত এই নগরের স্থাপত্য বিস্মিত করে পর্যটকদের।
একাদশ শতকে মাণ্ডু ছিল তরঙ্গগড় বা তরঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত। অবশ্য তারও আগে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে মাণ্ডু ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। সে সময় দেশ জুড়ে প্রতিবাদী আন্দোলনের ঢেউ। সেই সময়কার একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছে মাণ্ডু থেকে ১০০ কিমি দূরে তালনপুর খেকে।
সেখানে বলা হয়েছে, ‘মণ্ডপ’ বা ‘মাণ্ডু’র এক দুর্গে পার্শ্বনাথের মূর্তি স্থাপন করেছেন চন্দ্র সিংহ নামে জনৈক বণিক। এই ‘মাণ্ডু’ থেকেই নগরীর নামকরণ। ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে এই নগরী জয় করেন দিল্লির তৎকালীন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি।
১৪০১ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লং দিল্লি আক্রমণ করেন। সে সময় ঘোরী বংশের একটি শাখা সাম্রাজ্য বিস্তার করে। আফগান শাসক দিলাওয়ার খান ছিলেন মালওয়ার শাসক। তাঁর ছেলে হোশাং শাহ তাঁর রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান ধার থেকে মাণ্ডুতে।
এর পর দীর্ঘ কয়েক দশক মাণ্ডুর শাসনভার ছিল খিলজি বংশের একটি শাখার হাতে। মহম্মদ খিলজি এবং তাঁর ছেলে গিয়াসুদ্দিন খিলজির সময়কে বলা হয় মাণ্ডুর স্বর্ণযুগ।
এর পর মাণ্ডু ঘিরে আফগান ও মুঘলদের মধ্যে কয়েকশো বছর ধরে ক্ষমতার টানাপড়েন চলেছে। শেষ অবধি সম্রাট আকবর মাণ্ডু জয় করে সংযুক্ত করেন মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে। তার পরেও মরাঠাদের হাতে গিয়েছে এই শহরের শাসনভার।
তবে যুদ্ধ বিগ্রহ সবকিছুকে ছাপিয়ে মাণ্ডু বিখ্যাত হয়ে আছে বাজ বাহাদুর ও রানি রূপমতীর প্রেমপর্বের জন্য। বাজ বাহাদুর ছিলেন মাণ্ডুর শেষ আফগান সম্রাট। তার পর এর ক্ষমতাভার চলে যায় মুঘলদের হাতে।
বাজ বাহাদুর যুদ্ধবিগ্রহের থেকে বেশি মগ্ন ছিলেন রানি রূপমতীকে নিয়ে। কথিত, এক বার শিকারে গিয়ে এক পশুপালক তরুণীর গান শুনে মুগ্ধ হন সম্রাট বাজ বাহাদুর। সেই তরুণী-ই পরবর্তী সময়ের রানি রূপমতী। তাঁর জন্য বাজ বাহাদুর খালের মাধ্যমে মাণ্ডুর রেওয়া কুণ্ডে এনেছিলেন নর্মদার জল। অন্য দিকে, রানি রূপমতী ছিলেন একজন কবি-ও।
ইতিহাসের পাতায় অবশ্য এই প্রেমকাহিনির মর্মান্তিক পরিণতি হয়েছিল। মুঘলবাহিনীর আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছিলেন বাজ বাহাদুর। বিষপান করে আত্মঘাতী হন রানি রূপমতী। আজও মাণ্ডুতে দাঁড়িয়ে আছে বাজ বাহাদুর এবং রানি রূপমতীর প্রাসাদ। তাঁদের করুণ জীবনের সাক্ষ্য হয়ে।
মাণ্ডুর আর এক বিস্ময়-স্থাপত্য হল জাহাজ মহল। দু’টি কৃত্রিম হ্রদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাসাদকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটি জাহাজ অপেক্ষা করছে। এই জাহাজমহলেই ছিল সম্রাট গিয়াসুদ্দিন খিলজির হারেম। যেখানে ছিলেন বিভিন্ন দেশের কয়েক হাজার সুন্দরী।
মাণ্ডুর নজর কেড়ে নেওয়া স্থাপত্যের অন্যতম হোশাং শাহ ঘোরীর সমাধি। ১৪০৬ থেকে ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি মাত্র ২৯ বছর জীবিত ছিলেন মাণ্ডুর এই আফগান শাসক। বলা হয়, সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি তাঁর সমাধিস্থানের অনুসরণেই পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছিল আগরার তাজমহল। (ছবি: শাটারস্টক)