নিকিতা সিংহ।
মাঝরাতে এ ভাবে আচমকা ঘুম ভাঙার ধাক্কা বোধহয় জীবনভর আমায় তাড়া করে বেড়াবে।
প্রথমেই ভয়ঙ্কর একটা ঝাঁকুনি। তার পরে গোটা দুনিয়াটা ঝনঝনিয়ে কেঁপে ওঠা। এসি টু টায়ার, এ-ওয়ান কোচের আপার বার্থে জেগে উঠে তখন ধরে নিয়েছি, এ বার সব শেষ! ট্রেনটা নাগাড়ে কেঁপেই চলেছে। আর আমি ভাবছি, ওপর থেকে গড়িয়ে পড়তে আর কত ক্ষণ!
আশপাশ থেকে কান্নাকাটি-চিলচিৎকার ভেসে আসছে। আর প্রায় ফ্ল্যাশব্যাকের মতো আমাদের কলকাতার বাড়ি, মা-বাবার মুখ, ফ্যামিলি অ্যালবাম— সব অন্ধকার কামরাটায় ভেসে-ভেসে উঠছে। এই তো ইনদওরে মামার বাড়িতে কত মজা করে আমি বারাণসী ফিরছি। কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএড-এর ক্লাস আবার শুরু হবে। হবে কি? জীবনটাই পুরোপুরি খতম বলে তখন আমি মনে-মনে ধরে নিয়েছি।
কিন্তু ট্রেনের কাঁপুনি এক সময়ে থেমে গেল। একটা বিকট শব্দ! তার পর নড়নচড়ন সব বন্ধ। মনে হচ্ছিল, যেন কোনও পাহাড়ের খাড়াই ঢালে শুয়ে আছি।
একটা গলার স্বর কানে এল!
আপ লোগ শান্ত্ হো জাইয়ে। চিল্লাইয়ে মাত! ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট হুয়া হ্যায়। কোশিস কিজিয়ে কম্পার্টমেন্ট কে লাইট জ্বলানে কা...
হাতড়ে-হাতড়ে আলো জ্বালাতেই দেখলাম, নীচের বার্থের ‘আন্টি’ মেঝেয় পড়ে ছটফট করছেন। ভারী দু’খানা স্যুটকেস তাঁর উপরে পড়েছে। চেষ্টা করেও সরাতে পারছেন না।
আমার পাশের আপার বার্থে ছিল, বান্ধবী অমৃতা পাঠক। আমরা দু’জনেই ঢাল বেয়ে নেমে কামরায় দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ট্রেনটা এমন ভাবে এক দিকে হেলে আছে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোই যেন অসম্ভব। বার কয়েক চেষ্টা করেও আন্টির উপর থেকে স্যুটকেসগুলো সরাতে পারলাম না। শেষটা এসি কামরার খাবার রাখার তাকের কোণে এক পা রেখে নীচে ঝুঁকে যতটুকু পারি, চেষ্টা করলাম। অনেক চেষ্টায় সরানো গেল স্যুটকেসটা। আন্টি উঠে বসলেন।
তত ক্ষণে অনেকেই দমাদ্দাম বাড়ি মেরে জানলার কাচ ভাঙবার চেষ্টা করছেন। কামরা হেলে থাকার দরুণ এক দিকের দরজা দিয়ে বেরোন যাবে না! যাত্রীদের মধ্যে কয়েক জন ‘দাদা’ মিলে অন্য দিকের দরজাটা খোলার চেষ্টা করছিলেন। ওই দরজা দুটো তখন পুরো ‘জ্যাম’! কিছুতেই খুলছে না। হাতুড়ি না কী যেন একটা দিয়ে মেরে, মিনিট পনেরোর চেষ্টায় দরজা আলগা হল। বাইরেটা তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আমরা সবাই এক-এক করে নীচে নামছিলাম। রড ধরে একটু নীচে পৌঁছে, প্রায় ফুট ছয়েক উপর থেকে লাফ। ওই অচেনা সহযাত্রী দাদারাই ভরসা দিচ্ছিলেন, কিচ্ছু হবে না, নেমে এসো! তখন রাত সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছে। আমরা নেমে যাওয়ার পরে ওঁরা আবার ভিতরে ঢুকলেন। সবার ‘সামান’ ওঁরাই নামিয়ে দিলেন। ওই অবস্থায় ভয়ে কাঁদতে-কাঁদতে ভাবলাম, কলকাতায় বাবাকে ফোন করি! বাড়ির কারও গলাটা একবার শুনতে পাওয়া তখন খুবই জরুরি। ভিতরের উথাল-পাথাল ভাবটা কমবে। তা ছাড়া, ভাবছিলাম, একবার ঘুম ভেঙে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেলে, বাবা নিজেই পাগলের মতো করবে। তার থেকে যা ঘটেছে, আমার মুখ থেকেই না-হয় শুনে নিক।
আলো ফোটার আগে অবধি কত ভয়ঙ্কর অঘটন যে ঘটে গিয়েছে, তার কিছুই কিন্তু বুঝিনি। আমরা তো ইঞ্জিন থেকে তিন নম্বর কামরাটায় ছিলাম। মাঝে মোটে একটা কামরা, একই রকম হেলে রয়েছে! তার পরের কামরাটাই দেখি ধ্বংসস্তূপ। পিছনের কামরাগুলো সব তালগোল পাকানো অবস্থায়। কয়েক জন ‘দাদা’ মিলে ভিতর থেকে লোকজনকে বের করার চেষ্টা করছেন। পুলিশটুলিস আসতে-আসতে আরও আধ ঘণ্টা। আমার মাথা ভোঁ-ভোঁ করছিল। আমি আর অমৃতা শক্ত করে দু’জনে দু’জনকে ধরে ছিলাম!
বোধহয় সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে! আমাদের কামরার কয়েক জন ‘দাদা’ই খবর জোগাড় করলেন, কাছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে খানিকটা হেঁটে গেলে কানপুরের হাইওয়ে। সেখান থেকে গাড়ি ধরা যাবে! ওই দাদাদের ভরসাতেই ‘সামান’ নিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করি। মিনিট দশেক বাদেই পিচ সড়ক। একটা মারুতি ভ্যানও মিলে গেল কিছু ক্ষণেই। না, বারাণসীতে এখনই যাওয়ার সাহস হয়নি। লখনউয়ে আমার দিদির বাড়ি। আমরা ওখানেই চললাম।
ঘণ্টা চারেক বাদে লখনউয়ে পৌঁছে দিদিকে জড়িয়ে ধরে খানিক ক্ষণ বসেছিলাম। আতঙ্কে মুখে কথা সরছিল না। একটু খেয়ে, ঘুমিয়ে এখন শরীরে জোর পাচ্ছি। এ বার হয়ত দিদিদের সঙ্গেই বারাণসী ফিরব। তবে না! ট্রেন সফরের কথা এখন ভাবতেই পারছি না।
খালি মনে হচ্ছে, আমাদের ‘কোচ’টার পরে মোটে একখানা কামরা আস্ত ছিল! তার পরই সাক্ষাৎ মৃত্যু। একটা হঠাৎ ঝটকা খেলনা পুতুলের মতো সব ভেঙেচুরে ছারখার করে গিয়েছে।