বাগ্যুদ্ধের আগে। লালুপ্রসাদ দুই তরোয়ালধারীকে কাছে টেনে নিতেই কাকা শিবপালকে প্রণাম অখিলেশের। লখনউয়ে শনিবার। ছবি: পিটিআই।
সমাজবাদী পার্টির রজত জয়ন্তী সমারোহ হল। ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’-কে রোখার ডাক দিয়ে পুরনো জনতা পরিবারের ছয় দলের নেতাদের লখনউয়ে এনে মঞ্চে হাজিরও করলেন মুলায়ম সিংহ যাদব। কিন্তু মহাজোট তৈরির সেই মঞ্চেই তাঁর পরিবার ও দলের ফাটল প্রকাশ্যে চলে এল। খাপ খোলা তরোয়াল হাতে একে অপরকে নিশানা করে গেলেন উত্তরপ্রদেশের শাসক দলের যুযুধান কাকা-ভাইপো, শিবপাল ও অখিলেশ যাদব।
মিলিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা করেছিলেন লালুপ্রসাদ। রাজনীতিতে মুলায়মের পুরনো সঙ্গী তিনি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন মুলায়মের ভাইপোর সঙ্গে। লখনউয়ের জ্ঞানেশ্বর মিশ্র পার্কে সমারোহের শুরুতে, অখিলেশ ও শিবপালের হাতে তরোয়াল তুলে দেওয়া হয় উপহার হিসেবে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’জনকে কাছে টেনে নেন লালু। শিবপালের পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন অখিলেশ। ভাইপোর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদও করেন শিবপাল।
কিছু ক্ষণের মধ্যেই হাতে ধরা তরোয়ালের ধার যেন জিভে উঠে আসে দু’জনেরই। অখিলেশকে নিশানা করে শিবপাল বলেন, ‘‘কিছু লোক ঘরে বসে উত্তরাধিকার সূত্রেই সব পেয়ে যায়, যারা পরিশ্রম করে, দলের জন্য কুরবানি দেয়, তাদের কিছুই মেলে না।’’ নিজের অনুগামীদের উস্কে দিতে অখিলেশের উদ্দেশে বলেন, ‘‘কত ত্যাগ চাও আমার থেকে, রক্ত চাইলে তা-ও দিয়ে দেব, মুখ্যমন্ত্রী আমি হতে চাই না।’’ অখিলেশের পাল্টা, ‘‘কিছু লোকের মাথায় সব কিছুই ঢুকবে, তারা সব কথাই শুনবে, কিন্তু সমাজবাদী পার্টির ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর।’’
দু’সপ্তাহ আগে দলের সভায় মাইক নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছিলেন শিবপাল-অখিলেশ। মুলায়ম তবু দাবি করেছিলেন, তাঁর পরিবারে ও দলে কোনও ঝগড়া নেই। সবাই একজোট। ছেলে ও ভাইয়ের কাজিয়া ধামাচাপা দিতে দলের রজত জয়ন্তী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে পুরনো জনতা পরিবারের সদস্যদের একজোট করার কৌশল নেন। আপাত লক্ষ্য, উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে আটকানোর পাশাপাশি, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে মোদী-বিরোধী জোটের সলতে পাকানো। সে কাজে খানিকটা এগোলেও মুলায়মের দল ও পরিবারের অন্দরের ফুটিফাটা চেহারাটা আজ বেরিয়ে পড়ল ফের।
দু’সপ্তাহ আগের মতো আজ অবশ্য শিবপাল-অখিলেশ নিজেরা মাইক কাড়াকাড়ি করেননি বা হাতাহাতিতে জড়াননি। তবে অখিলেশ-অনুগত জাভেদ আবিদি মাইক কব্জা করে গলা ফাটিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন দেখে, দ্রুত মুলায়মের সম্মতি নিয়ে শিবপাল তাঁকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে মাইকের দখল নেন তাঁর অনুগামী ওমপ্রকাশ সিংহ। অখিলেশকে সরিয়ে মুলায়ম শিবপালকে রাজ্য সভাপতি করার পরেই কাকা-ভাইপোর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন শিবপাল ও তাঁর অনুগত শাদাম ফতিমা, গায়ত্রীপ্রসাদ প্রজাপতিদের। সেই গায়ত্রীপ্রসাদই আজ ছিলেন অনুষ্ঠানের মূল হোতা। তিনিই উপহার হিসেবে তরোয়াল নিয়ে এসেছিলেন শিবপাল-অখিলেশের জন্য। অনুষ্ঠানটি দলের। তাই রাজ্য সভাপতি হিসেবে শিবপালই ছিলেন এর আয়োজক। মুলায়ম ছিলেন প্রধান অতিথি। অখিলেশ এসেছিলেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। সুযোগটা হাতছাড়া করেননি অখিলেশ। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভা থেকে কাউকে বরখাস্ত করার পুরো অধিকার যে তাঁর রয়েছে, তা জাহির করতেই যেন অখিলেশ বলেন, ‘‘আমার হাতে তরোয়াল দেবে, অথচ চাইবে আমি তরোয়াল চালাবো না, এমনটা কী করে হতে পারে!’’
অখিলেশ বুঝিয়ে দেন, তাঁর সরকারের কাজ দেখেই রাজ্যবাসী তাঁকে ভোট দেবেন বলে তিনি মনে করছেন। যে কাজের খতিয়ান নিয়ে দু’দিন আগেই তিনি রথযাত্রা শুরু করেছেন। দায়িত্বে রেখেছেন তাঁদের, শিবপাল যাঁদের দল থেকে তাড়িয়েছেন। কাকা শিবপালও কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন ভাইপোর দিকে। বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীজি, আমিও সরকারকে অনেক সাহায্য করেছি। যতই বরখাস্ত করুন বা অপমান, কাজ আমি আপনার থেকে বেশি করেছি।’’
প্রমাদ গুনছেন সমাজবাদী পার্টির নেতারা। সংগঠনের রাশ শিবপালের হাতে। ভোটে তিনিই যদি অখিলেশের রথের চাকা মাটিতে বসিয়ে দেন! কাকা-ভাইপোর এই তরজায় ঘোষিত ভাবেই খুশি মায়াবতী। তাঁর দাবি, ভোটে শিবপাল ও অখিলেশের অনুগতরাই একে অন্যকে হারানোর চেষ্টা করবে। উত্তরপ্রদেশের সহারনপুরে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বেঁধেন যাদব পরিবারকে। তাঁর কটাক্ষ, ‘‘যাঁদের রাজ্য চালানোর কথা তাঁরা নিজেদের পরিবারই সামলাতে পারছেন না!’’
এ দিনের সমারোহে নীতীশ কুমার নিজে যাননি। পাঠিয়েছিলেন শরদ যাদবকে। লালুপ্রসাদ ছাড়াও ছিলেন জেডি(এস)-এর এইচ ডি দেবগৌড়া, আইএনএলডি-র অভয় চৌটালা ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা অজিত সিংহ। মুলায়ম বিহারের মতোই উত্তরপ্রদেশে মহাজোট চাইলেও, অজিত সিংহ ছাড়া বাকি কারও তেমন প্রভাব নেই এ রাজ্যে। মুলায়ম-অজিত প্রাতরাশ বৈঠকে আজ নীতিগত ভাবে সমঝোতা হয়েছে দু’দলের মধ্যে। আসন রফার বিষয়টি পরে স্থির হবে। বাকি নেতারা কিন্তু এ দিনের সমারোহকে লোকসভা ভোটের জন্য ঘুঁটি সাজানো হিসেবেই দেখতে চাইছেন। সেখানে কংগ্রেসকেও সঙ্গে নিতে চান তাঁরা। অখিলেশ কতটা চান, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও উত্তরপ্রদেশের ভোটেই শেষবেলায় কংগ্রেস কি হাত মেলাবে তাঁদের সঙ্গে?
জল্পনা উস্কে দিয়েছেন কংগ্রেসের রণকৌশল তৈরির ভার পাওয়া প্রশান্ত কিশোর। জনতা পরিবারের নেতাদের সঙ্গে আজ একই হোটেলে ছিলেন তিনি। আজ অখিলেশের সঙ্গে প্রশান্ত বৈঠকও করেছেন বলে লখনউয়ে জল্পনা তুঙ্গে। যদিও এর সত্যতা স্বীকার করেননি কেউ। ক’দিন আগে মুলায়মের সঙ্গেও এক দফা বৈঠক করেছেন প্রশান্ত।
চাচা-ভাতিজা আর ওঁরা
• আমিও সরকারকে অনেক সাহায্য করেছি। যতই বরখাস্ত করুন বা অপমান, কাজ আমি আপনার থেকে বেশি করেছি।
• কিছু লোক উত্তরাধিকার সূত্রেই সব পেয়ে যায়। যারা পরিশ্রম করে, দলের জন্য কুরবানি দেয়, তাদের কিছু মেলে না।
• অখিলেশকে বলতে চাই, কত ত্যাগ চাও আমার থেকে, রক্ত চাইলে তা-ও দিয়ে দেব, মুখ্যমন্ত্রী আমি হতে চাই না। —শিবপাল যাদব
• কিছু লোকের মাথায় সব কিছুই ঢুকবে, তারা সব কথাই শুনবে, কিন্তু পার্টির ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর।
• আমার হাতে তরোয়াল দেবে, অথচ চাইবে আমি তরোয়াল চালাবো না, এমনটা কী করে হতে পারে!
• যুবকদের আনুগত্যের পরীক্ষা নিও না। কারও পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। পরীক্ষা দিতে হলে আমি তৈরি। —অখিলেশ যাদব
• চাচা ভাইপোকে গাল দিচ্ছে, ভাইপো চাচাকে। উন্নয়ন নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। —অমিত শাহ
• ফাটল বেরিয়ে পড়ছে। শিবপাল ও অখিলেশের সমর্থকরা একে অন্যকে হারানোর চেষ্টা করবে।—মায়াবতী