অখিলেশ সিংহ যাদব ফাইল চিত্র।
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ চলার মধ্যেই উত্তরপ্রদেশে মে মাসে ব্লক পঞ্চায়েতে বিপুল ভাবে পরাজিত হয় বিজেপি। কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই ভাল ফলাফল করে অখিলেশ সিংহ যাদবের এসপি। রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরের মতে, মে মাসের সেই জয়কে বিধানসভা ভোটে কাজে লাগানোর জন্য সে ভাবে মাঠে দেখা যাচ্ছে না অখিলেশ তথা তাঁর দলকে। যেখানে কোভিড-মোকাবিলার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতাকে অস্ত্র করে এবং ব্লক পঞ্চায়েতে মানুষের প্রকাশ্য ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, সেখানে এখনও পর্যন্ত কোনও বড় মাপের জনসভা করতে দেখা যায়নি অখিলেশকে। অথচ নির্বাচনের আর বাকি মাত্র পাঁচ মাস।
রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরের মতে, গত দেড় বছরে অখিলেশ যতটা বিদেশে সময় কাটিয়েছেন, তার সিকিভাগও তাঁকে লখনউয়ে দেখা যায়নি। বিভিন্ন জেলা এবং প্রত্যন্ত গ্রামে তো নয়ই। গত বছর হাথরসে দলিত কিশোরীর ধর্ষণ-খুনের পরে গোটা দেশের সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিরোধী নেতাদের রাস্তায় নামতে সে ভাবে দেখা যায়নি। গোটা সময়টাই বিদেশে ছিলেন মুলায়ম সিংহের পুত্র। মায়াবতী রাজ্যে থেকেও এক বারও ঘটনাস্থলে যাননি। কংগ্রেসের উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক প্রিয়ঙ্কা বঢরা এবং রাহুল গাঁধী নয়াদিল্লি থেকে হাথরস ‘পদযাত্রা’ শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের এগোতে দেওয়া হয়নি। তার পরে আর কোনও বিরোধী পক্ষের থেকে সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি
সে ভাবে।
এসপি-র পক্ষ থেকে মাস তিনেক আগেই বলা হয়েছিল, প্রত্যেকটি ব্লকের আলাদা করে কমিটি এবং নেতা বেছে নেওয়া হবে ভোটকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে ভাবে কোনও তোড়জোড় নেই। যাদব, ওবিসি, ব্রাহ্মণ, অন্যান্য জাত এবং মুসলমান ভোটকে এক ছাতার তলায় নিয়ে না আসতে পারলে এসপি-র পক্ষে বিজেপি-র হিন্দুত্বের ঢেউকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। কিন্তু সে জন্যও কোনও কোমর কষে প্রয়াস করতে দেখা যাচ্ছে না অখিলেশকে। গত দেড় বছর ধরে দিল্লির সীমানা্য় কৃষক বিক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সম্পন্ন এবং ছোট ও মাঝারি কৃষকেরা ধর্নায় বসে রয়েছেন লাগাতার। এই কৃষক আন্দোলনকে ভোটের অন্যতম বিষয় করে তোলাই ছিল এসপি-র পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু জাঠ কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত যে ভাবে এই আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, তার ধারে কাছেও যেতে পারলেন না অখিলেশ। ফলে করোনা, জাতপাতের রাজনীতি, কৃষক আন্দোলনের মতো একের পর এক বিষয় অখিলেশের হাতের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে, অখিলেশের এই উদাসীনতার কারণ কী? উত্তরপ্রদেশের আর এক বিরোধী বিএসপি নেত্রী মায়াবতী উনিশের লোকসভা ভোটের পরেই এসপি-র সঙ্গে জোট ছিন্নই শুধু করেননি, কার্যত বিজেপি-র বি দল হিসেবেই থেকে গিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বারবার। পুরনো মামলা খুঁচিয়ে তুলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে দলিত নেত্রীর পিছনে লাগানোর পরই তিনি গুটিয়ে রয়েছেন বলে রাজনৈতিক শিবিরের ধারণা। প্রশ্ন ইঠছে তাহলে কি অখিলেশের উপরেও কোনওভাবে চাপ তৈরি করছে কেন্দ্রীয় সরকার তথা তদন্তকারী সংস্থা?
উত্তরপ্রদেশের ভোট পর্যবেক্ষকরা একথাও বলছেন, ‘বহেনজি’ তথা মায়াবতীর রাজনীতির ধরন হল যে বিপক্ষের যতই চাপ থাক, নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে তিনি নড়ে চড়়ে বসেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপান। তাঁর দলও এ ভাবে ভোট করতে অভ্যস্ত। এ ক্ষেত্রেও যদি তাই হয়, তাহলেও কোনও বিরোধী মহাজোটের অভাবে আখেরে লাভ হবে বিজেপিরই। দলিত ভোট ভাগ হবে, এসপি আরও হীনবল হবে। পাশাপাশি এমআইএম-এর আসাদুদ্দিন ওয়েইসি মাঠে নেমেছেন মুসলমান ভোটের লক্ষ্যে। এর পিছনে বিজেপি-র কোনও রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে কি না সে প্রশ্নও উঠছে। তাই নিজেদের মুসলমান, জাঠ এবং দলিত ভোটকে একজোট করতে বাড়তি উদ্যোগ প্রয়োজন অখিলেশ যাদবের।
রাজনৈতিক শিবিরের মতে, ২০১২ সালে অখিলেশের জয়ের পিছনে ছিল মুলায়ম সিংহ যাদবের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। যাদব সম্প্রদায়ের পাশাপাশি তিনি ওবিসি-র মঞ্চকে আরও প্রসারিত করতে পেরেছিলেন দলের জন্য। ঠাকুর, ব্রাহ্মণ ছাড়াও কুর্মির মতো আরও অনেক ক্ষুদ্র সম্প্রদায়কে এসপি-র ছাতার তলায় এনেছিলেন। একই ভাবে ২০০৭ সালে বিএসপি-র দলিত এবং অন্যান্য জাতকে সঙ্গে নেওয়ার রাজনীতি ফলপ্রসূ হয়। তাঁর ‘ব্রাহ্মণ ভাইচারা সম্মেলন’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল সেই কাজে। আসন্ন বাইশের ভোটেও ঠিক একই ভাবে ব্রাহ্মণ, ওবিসি, এবং অন্যান্য জাতকে একজোট করার প্রয়োজন বিজেপি-কে হারাতে গেলে। সেই সঙ্গে জরুরি মুসলমানদের অটুট আস্থা অর্জন। কিন্তু সেই কাজের জন্য মরিয়া হয়ে ভোট ময়দানে ঝাঁপানো দরকার। ‘আব্বাজান’ বলেই হোক অথবা তালিবানি বিপদের জুজুকে কাজে লাগিয়ে, হিন্দু ভোট একজোট করার জন্য কিন্তু প্রবলভাবে রাজ্যে সক্রিয় যোগী আদিত্যনাথ। এই ভোট তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্বেরও লড়াই। কিন্তু তাঁর প্রধানতম প্রতিপক্ষ অখিলেশ যাদব, এখনও প্রচারের দৌড়ে অনেকটাই পিছিয়ে—এমনটাই মনে করছে রাজ্যের রাজনৈতিক শিবির।