ফের সক্রিয় জঙ্গিরা, ইদের আগেও রক্তাক্ত কাশ্মীর

এ যেন শাঁখের করাত। এক দিকে জনতার বিক্ষোভ, অন্য দিকে জঙ্গি উপদ্রব। কাশ্মীরে কোন দিকটা কী ভাবে সামাল দেবে, ভেবে কূল পাচ্ছে না নরেন্দ্র মোদী সরকার। জঙ্গি নেতা বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পরে গত দু’মাস ধরে বিক্ষোভে উত্তপ্ত ছিল কাশ্মীর।

Advertisement

সাবির ইবন ইউসুফ ও অনমিত্র সেনগুপ্ত

শ্রীনগর ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২৩
Share:

সামনে শত্রু। রবিবার সংঘর্ষের সময়ে পুঞ্চের একটি বাড়ির সামনে সেনা। ছবি: পিটিআই

এ যেন শাঁখের করাত। এক দিকে জনতার বিক্ষোভ, অন্য দিকে জঙ্গি উপদ্রব। কাশ্মীরে কোন দিকটা কী ভাবে সামাল দেবে, ভেবে কূল পাচ্ছে না নরেন্দ্র মোদী সরকার।

Advertisement

জঙ্গি নেতা বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পরে গত দু’মাস ধরে বিক্ষোভে উত্তপ্ত ছিল কাশ্মীর। সে আগুন এখনও নেভেনি। এমনকী ইদের দিনও জনবিক্ষোভ বন্ধ না রাখারই সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ পরিস্থিতি যাতে কিছুটা থিতিয়ে যায়, তার জন্যই সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল জঙ্গি দমন অভিযান। সেই সুযোগে এ দিন সন্ত্রাস আবার মাথা চাড়া দিল। রবিবার পুঞ্চ এবং নওগাম এলাকায় জোড়া অপারেশনে সাত জঙ্গি মারা গেল। প্রাণ হারালেন পুলিশের স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপের এক কনস্টেবল আর কুমার-ও।

দুয়ে মিলে ইদের দু’দিন আগে উৎসবের মেজাজ তো দূর, আরও যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ল কাশ্মীর।

Advertisement

আজ সকালে প্রথমে পুঞ্চের দু’টি বাড়িতে জঙ্গিরা ঘাঁটি গেড়েছে বলে খবর পায় বাহিনী। একটি বাড়ি আল্লাহ পির এলাকায় সেনা সদরের খুব কাছে, অন্যটি জেলা পুলিশ সুপারের বাড়ির কাছে একটি নির্মীয়মাণ সরকারি ভবন। বসতবাড়িটির নাম যোগিন্দর মহল। বাড়ির মালিক হাজি নাসির মির জেলার পরিচিত কংগ্রেস সমর্থক। জম্মু-কাশ্মীর বিধান পরিষদের সদস্য জাহাঙ্গির হুসেন মির-এর আত্মীয়। রবিবার সকালে জঙ্গিরা যখন বাড়িতে ঢোকে হাজি নাসির এবং তাঁর স্ত্রী মমতাজ মির একটি ঘরে নিজেদের তালাবন্ধ করে রাখেন। কার্যত পণবন্দি পরিস্থিতি তৈরি হয়। সন্ধে সাতটা পর্যন্ত জঙ্গিদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলে বাহিনীর। শেষ পর্যন্ত তিন জঙ্গিকে নিকেশ করে অক্ষত অবস্থাতেই উদ্ধার করা হয় মির দম্পতিকে।

অন্য বাড়িটিতে অপারেশন রাত পর্যন্ত চালু রয়েছে। এক জঙ্গি সেখানে লুকিয়ে রয়েছে বলে দাবি পুলিশের। আবার এ দিনই নওগাম, টংধার ও গুরেজ সেক্টরে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায় জঙ্গিদের তিনটি দল। সেই চেষ্টা রুখে দিয়েছে সেনা। সংঘর্ষে নিহত হয়েছে চার জঙ্গি।

জঙ্গি দমনের নামে সেনা সক্রিয়তার বাড়াবাড়ি এবং সাধারণ মানুষের হয়রানির অভিযোগ নিয়েই গত দু’মাস ধরে রাস্তায় নেমে এসেছেন কাশ্মীরের মানুষ। তার উত্তরে সেনা-পুলিশ যে ভাবে ছররা বৃষ্টি করেছে, তাতে ঘরে-বাইরে মুখ পুড়েছে মোদী সরকারের। আজ বিকেলে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। তাতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালও ছিলেন। সেখানে মন্ত্রকের কর্তারা জানিয়েছেন, গত দু’মাস ধরে অশান্তির জেরে কাশ্মীরের প্রত্যন্ত ও গ্রামীণ এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর গতিবিধি কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে এলাকাগুলির প্রতিদিনের খবর পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, দক্ষিণ কাশ্মীর থেকে সম্প্রতি প্রায় ১৫০ জন স্থানীয় যুবক নিখোঁজ হয়েছে। তারা হিজবুল মুজাহিদিন ও লস্কর-ই-তইবার হয়ে কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই অবস্থায় সামনে আরও সংঘর্ষ অপেক্ষা করছে বলে আশঙ্কা গোয়েন্দাদের। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে পুলওয়ামা, অনন্তনাগের মতো কয়েকটি জেলার উপরে বিশেষ নজর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। রাজনাথ চাইছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে শান্তি ফিরুক উপত্যকায়। কারা জনতাকে উত্তেজিত করছে, সেটা খুঁজে বার করার উপরে জোর দিচ্ছেন তিনি।

আবার খুব বেশি ধরপাকড় করতে গেলে সাধারণ মানুষের বিরূপতা আরও বাড়বে, সে আশঙ্কাও রয়েছে পুরোমাত্রায়। আজও, পুলিশ সূত্রে খবর, পুলওয়ামার করিমাবাফ গ্রামে তল্লাশি চালাচ্ছিল যৌথ বাহিনীর একটি দল। তখন জওয়ানদের লক্ষ করে পাথর ছোড়ে স্থানীয় যুবকরা। সংঘর্ষে আহত হয় ২৫ জন যুবক। গত সপ্তাহে বাদগামে এমনই এক সংঘর্ষে আহত একটি যুবক আজ মারা গিয়েছেন। ফলে সামগ্রিক ভাবে কাশ্মীরের প্রতিবাদী মেজাজও শান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইদের দিনও সারা কাশ্মীর জুড়ে ‘আজাদি যাত্রা’র ডাক দিয়েছেন হুরিয়ত নেতারা। শ্রীনগরে রাষ্ট্রপুঞ্জের সামরিক পর্যবেক্ষকের অফিসের দিকে মিছিল করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। স্থানীয় ভাবেও প্রতিটি ইদগাহে আজাদি যাত্রার তোড়জোড় চলছে।

এ সবের মাঝে ঝিমোচ্ছে ইদের বাজার। ভেড়া-ছাগল কেনার উৎসাহ চোখে পড়ছে না। টানা কার্ফু আর হরতালের জেরে মার খেয়ে গিয়েছেন পশুবিক্রেতারা। যে সব পরিবার অন্যান্য বার তিনটি ভেড়া কিনত, তারা বড়জোর একটি কিনছে। কারণ উৎসব করার মন বা উপায় কোনওটাই নেই। কাশ্মীরিরা বলছেন, ইদের ভোজ আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে বিলি করাটাই দস্তুর। কিন্তু কার্ফুর চক্করে দূরে কোথাও যাওয়াই যাচ্ছে না। বকরি বা নতুন জামাকাপড় কিনে লাভ কী তবে? শহরের পুরনো মহল্লার এক মহিলা বললেন, তাঁরাও ইচ্ছে করেই কেনাকাটা কম করছেন। বেঁচে যাওয়া টাকা দিতে চান আহতদের পরিবারকে। যাঁরা জোরকদমে কেনাকাটা শুরু করেছিলেন, তাঁরাও ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছেন। তেমনই এক জন বললেন, তাঁর আত্মীয়রা নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছেন। সকলকে দেওয়া-থোওয়ার জন্য তিনটি ভেড়া কিনেছিলেন। ‘‘শনিবার সব কিনেকেটে ঘরে এসেই শুনলাম, সেনাবাহিনী আরও দুই যুবককে হত্যা করেছে। এই অবস্থায় ইদ পালন করব কী করে?’’

এমন বিষণ্ণ ইদ-মরসুম কাশ্মীর বহুকাল দেখেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement