গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের ‘উত্তরাধিকার’ আর কোনও ঠাকরের হাতে রইল না। বিধানসভা ভোটের ফলাফল স্পষ্ট করে দিল, মরাঠা রাজনীতিতে বালাসাহেবের ‘রাজনৈতিক উত্তরসূরি’ এখন একনাথ শিন্ডে। যে বালাসাহেবের হাত ধরে শিবসেনার জন্ম, তাঁর উত্তরাধিকারী পুত্র উদ্ধব হেরে গেলেন যুদ্ধে। ধরাশায়ী ভ্রাতুষ্পুত্র রাজ ঠাকরেও।
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রিত্ব, অবিভক্ত শিবসেনার নির্বাচনী প্রতীক ‘তির-ধনুক’ এমনকি, বালাসাহেব প্রতিষ্ঠিত দলের নামটিও আগেই কেড়ে নিয়েছিলেন শিন্ডে। এ বার উদ্ধবের কাছ থেকে তিনি ছিনিয়ে নিলেন উদ্ধবের প্রয়াত পিতার একান্ত অনুগত মরাঠি ভোটব্যাঙ্কও। অতঃপর পুত্রের হাতে রইল শুধু পিতার স্মৃতিবিজড়িত ‘মাতোশ্রী’।
মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটের ফলাফল বলছে, ২৮৮ আসনের বিধানসভায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ-র সহযোগী হিসাবে ৮১টি আসনে লড়ে ৫৬টিতে জিততে চলছে শিন্ডেসেনা। তাদের ঝুলিতে প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট। অন্য দিকে, ‘ইন্ডিয়া’র শরিক উদ্ধবসেনা প্রায় ১১ শতাংশ ভোট পেলেও ২০-র বেশি আসনে জিততে পারছে না।
উদ্ধব-পুত্র আদিত্য মুম্বইয়ের ওরলিতে এবং তাঁর তুতো তাই বরুণ সরদেশাই বান্দ্রা পূর্ব আসনে জিতলেও রাজন বিচারে, সুনীল প্রভুর মতো বিশ্বস্ত সহযোগীরা হেরেছেন। আবার শিন্ডে ঠাণে জেলায় তাঁর পুরনো আসন কোপরি-পাচপাখাড়িতে হারিয়েছেন তাঁর ‘রাজনৈতিক গুরু’ তথা শিবসেনার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রয়াত আনন্দ দিঘের ভাইপো কেদারকে। দীপক কেশরকর (সাওয়ন্তওয়াড়ি), উদয় সাওয়ন্ত (রত্নগিরি), সঞ্জয় রাঠৌরের (দিগরস) মতো শিন্ডের ঘনিষ্ঠেরাও জয়ের পথে। এমনকি, কংগ্রেস ছেড়ে আসা সঞ্জয় নিরুপম (দিন্দোসি) এবং বিজেপি-ছুট নীলেশ রানে (বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নারায়ণ রানের পুত্র তথা কুদল আসনে শিন্ডেসেনার প্রার্থী) জিততে চলেছেন।
শিন্ডের উত্থানকাহিনি
মহারাষ্ট্রে ২০১৯ সালে শেষ বিধানসভা নির্বাচনে জোট করে লড়েছিল শিবসেনা-বিজেপি। ভোটের পরেই জোট ভাঙে। বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে শরদ পওয়ারের এনসিপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলান উদ্ধব। গোড়ায় এনসিপি বিধায়ক এবং শরদের ভাইপো অজিত পওয়ারের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হন বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়ণবীস। কিন্তু সে সরকার দিন দুয়েকের বেশি টেকেনি। এর পরে শিবসেনা, এনসিপি এবং কংগ্রেসের জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন উদ্ধব। শিন্ডেকে তিনি নগরোন্নয়ন ও পূর্ত দফতরের দায়িত্ব দেন।
২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের রাজনীতির বাইরে শিবসেনা নেতা শিন্ডের তেমন কোনও পরিচিতি ছিল না। সে বছর ২০ জুন একদল শিবসেনা বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তিনি শিরোনামে। প্রথমে গুজরাত, তার পর অসম এবং তার পরে গোয়া— তিন বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিক্ষুব্ধ বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী এবং দলের শীর্ষনেতা উদ্ধবের সঙ্গে দর কষাকষি চালাতে থাকেন। এক সময়ে বোঝা যায়, শিবসেনার অধিকাংশ বিধায়কই শিন্ডের সঙ্গে রয়েছেন। অতঃপর নিরুপায় উদ্ধবের ইস্তফা। ৩০ জুন বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে নতুন সরকার গড়েন শিন্ডে। উপমুখ্যমন্ত্রী হন বিজেপির ফডণবীস। এর পরে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এনসিপি প্রধান শরদের ভাইপো অজিতও কাকার দলের অধিকাংশ বিধায়ককে নিয়ে এনডিএ-তে শামিল হন। পান উপমুখ্যমন্ত্রী পদ। এ বারের ভোটের ফল বলছে, ‘সাহেব’ (মরাঠা রাজনীতিতে এই নামেই পরিচিত শরদ) শরদের দলকে টেক্কা দিয়ে পশ্চিম মহারাষ্ট্রের মরাঠা ভোট কব্জা করেছেন ‘ভাই’ অজিত।
আশির দশকে কলেজের পড়া ছেড়ে বালাসাহেবের ডাকে সাড়া দিয়েই সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন শিন্ডে। আদতে মহারাষ্ট্রের সাতারার বাসিন্দা হলেও রাজনীতির ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিবসেনার শক্ত ঘাঁটি ঠাণেকে। অচিরেই সেখানকার প্রভাবশালী শিবসেনা নেতা আনন্দ দীঘের ‘ডানহাত’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রথম ভোট-রাজনীতিতে পা রাখেন ১৯৯৭ সালে। ঠাণে পুরসভার নির্বাচনে জিতে। ২০০৪ সালে প্রথম মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটে জেতেন ঠাণেরই কোপরি-পাচপাখাড়ি কেন্দ্র থেকে। তার আগে ২০০১ সালে রাজনৈতিক গুরু আনন্দের অকালপ্রয়াণের পর ঠাণে-সহ আশপাশের জেলাগুলির শিবসেনা সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল শিন্ডের হাতেই। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে উদ্ধবের গড় মুম্বই এবং কোঙ্কণ উপকূলেও প্রভাব বাড়ে শিন্ডের।
শিন্ডের রাজনৈতিক উত্থানে নানা সময়ে ভাগ্যও সাহায্য করেছে। ২০০৯ সালের বিধানসভা ভোটে গুহাগড় কেন্দ্রে অপ্রত্যাশিত ভাবে হেরে যান উদ্ধব-ঘনিষ্ঠ বিরোধী দলনেতা রামদাস কদম। বিধানসভায় শিবসেনার দলনেতার দায়িত্ব পান শিন্ডে। এর পরে ২০১৪ সালের বিধানসভা ভোটে জিতে ফডণবীস সরকারের মন্ত্রীও হন। সে বছরই লোকসভা ভোটে কল্যাণ কেন্দ্রে জিতে সাংসদ হন তাঁর পুত্র শ্রীকান্ত। এ বার লোকসভা ভোটে মহারাষ্ট্রে বিরোধী জোট ভাল ফল করলেও শ্রীকান্ত জিতেছেন নিজের আসনে। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে অবশ্য দুই শিবসেনার তুল্যমূল্য লড়াই হয়েছে। শিন্ডেসেনা ১৫টিতে লড়ে সাতটিতে জিতেছে। উদ্ধবসেনা ২১টিতে লড়ে ৯টিতে। কিন্তু বিধানসভায় প্রতিষ্ঠিত হল শিন্ডেরই ‘কর্তৃত্ব’।
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
শিবসেনার ভাঙন এবং আর এক ঠাকরে
ষাটের দশকে হিন্দুত্ববাদী আদর্শ এবং মরাঠি মানুষের স্বার্থরক্ষার যে অঙ্গীকার করে বালাসাহেব নয়া দল ‘শিবসেনা’ গড়েছিলেন, অতীতেও তাতে কয়েক বার ভাঙন ধরেছে। কিন্তু সে সব ক্ষেত্রে দলের ‘আদর্শ ‘ছিনতাই’-এর সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। ছগন ভুজবল, নারায়ণ রানের মতো ‘ওজনদার’ মরাঠি নেতারা সে চেষ্টা করেনওনি। কারণ, বিপরীত আদর্শের দল কংগ্রেসে নাম লিখিয়েছিলেন তাঁরা। সে দিক থেকে দেখতে গেলে প্রথম বার সেই দাবি শোনা গিয়েছিল রাজ ঠাকরের মুখে। ২০০৬ সালে বালাসাহেবের জীবদ্দশাতেই তাঁর প্রিয় ভাইপো রাজ শিবসেনার সঙ্গ ছেড়ে নিজের দল মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) গড়েছিলেন। পিতৃব্যের নামে একটিও অভিযোগ না করলেও প্রকাশ্যে উদ্ধবের ‘নেতৃত্বগুণ’ নিয়ে কটাক্ষ করেছিলেন তিনি।
সুবক্তা রাজ রাজনীতিতে এসেছিলেন উদ্ধবের অনেক আগে। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতাও ছিল সুবিদিত। বস্তুত, দীর্ঘ দিন বালাসাহেবের ‘রাজনৈতিক সহযোগী’ ছিলেন রাজই। সে সময় উদ্ধব ব্যস্ত থাকতেন বন্যপ্রাণীদের ক্যামেরাবন্দি করার শখ নিয়ে। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে মরাঠি জনসমাজে ঢেউ তুললেও দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতিতে সফল হতে পারেননি রাজ। এমএনএস গঠনের পরে ২০০৯ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ নিঃসন্দেহে ছিলেন একটি ‘ফ্যাক্টর’। রাজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ ভোট নিয়ে, শিবসেনার সঙ্গে পাঞ্জা কষে (তখনও বালাসাহেব বেঁচে এবং লড়াইয়ের ময়দানে) পেয়েছিলেন ১৩টি আসন। ‘মরাঠি অস্মিতা’র বিষয়টি সামনে রেখে সে দিন তিনি শুধুমাত্র বিজেপি এবং শিবসেনার দুর্গে আঘাত হানেননি, ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে একটি বড় সম্ভাবনা তৈরি করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু ‘কট্টরপন্থী’ অবস্থান এবং হিংসাত্মক আন্দোলনের কারণে ক্রমশ মরাঠা রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন রাজ। ২০১৪ সালের বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তাঁর দল। ৩ শতাংশ ভোট পেয়ে সে বার মাত্র একটি কেন্দ্রে জিতেছিল এমএনএস। ২০১৯ সালেও একটিই আসন ঝুলিতে আসে। কিন্তু চলতি বছরের লোকসভা ভোটে রাজ প্রার্থী না দিয়ে নিঃশর্তে সমর্থন করেছিলেন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-কে। এ বার ১২৫টি আসনে লড়তে নেমেছিল তাঁর দল। এর মধ্যে মুম্বইয়ের ২৫টি-সহ রাজ্যের ৩৮টি আসনে তারা ‘ফ্যাক্টর’ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু তা হয়নি। মুম্বইয়ের মাহিম আসনে লড়ে রাজের পুত্র অমিত তৃতীয় হয়েছেন।
উদ্ধব এবং রাজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অতঃপর কী হতে চলেছে, তা নিয়ে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে আলোচনা চলবেই। কিন্তু যা নিয়ে তর্ক চলবে না— বালাসাহেবের ‘উত্তরাধিকার’ আর কোনও ঠাকরের হাতে রইল না।