Afghanistan

Afghanistan: রক্তাক্ত দেশ, অস্থির অসমের আফগান জামাই

শৈশবে বাপ-মা মরা ছেলেটি স্কুলে যেতে পারেনি। পরিচিত খান ভাইয়ের হাত ধরে রোজগারের আশায় অসমে পা রেখেছিল সেই ১৯৮০ সালে।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২১ ০৭:৪২
Share:

ফাইল চিত্র

চল্লিশ বছর হয়ে গেলে ছেড়ে এসেছেন নিজের দেশ, নিজের শিকড়। এখনও চোস্ত পুশতু ভাষায় শায়েরি আওড়ান মেজাজ খুশ থাকলে। কিন্তু মেজাজ ভাল থাকার উপায় রাখছে না ওই বাগি পাখতুনের দল! টিভিতে যত দেখছেন তাঁর জন্মভূমি আফগানিস্তান তালিবান দখলে চলে যাচ্ছে, অস্থির হয়ে পড়ছেন প্রিন্স ওরফে শাহজাদা খান।

Advertisement

বাংলা কথা বলতে বলতেই পুশতু আওড়াতে থাকেন: “গুল্লৌনা ওয়াকারা সি শিমা দি গুলজ়ার শি / আঘাজ়ি মাকারা ফশৌ কি ওয়াদি লারহ শি।” প্রতিবেদক কিছুই বুঝতে পারেননি খেয়াল করে মানেটা বলে দিলেন শাহজাদা নিজেই, বাগানে ফুলগাছ লাগালে সৌন্দর্য ও সৌরভ তো পাবেন, কিন্তু কাঁটাওয়ালা ফুলগাছ বসালে কাঁটার খোঁচা খেতেই হবে। বিক্ষত কণ্ঠে বলে চলেন, পাকিস্তানের হাতের পুতুল পাখতুন জনজাতি আমার সাধের দেশের সৌন্দর্য বারবার কাঁটার খোঁচায় রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। আমরা আদি আফগান বা পাখতুনরা সকলেই শান্তি ভালবাসি (আমন-পসন্দ)। কিন্তু টাকা দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে দস্যুদের সাহায্য করে শান্ত-সুন্দর আফগানিস্তানকে শেষ করে দিচ্ছে পাকিস্তান।”

শৈশবে বাপ-মা মরা ছেলেটি স্কুলে যেতে পারেনি। পরিচিত খান ভাইয়ের হাত ধরে রোজগারের আশায় অসমে পা রেখেছিল সেই ১৯৮০ সালে। আফগানিস্তানের ঝরগোন প্রদেশের বখাইল গ্রাম থেকে শাহজাদার সাকিন বদলে হয়ে গিয়েছিল কামরূপের মির্জা। থানার পাশে জমি কিনে ব্যবসা শুরু করা তরুণকে পছন্দ করে, স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান তাঁর কন্যা জাহানারার হাত তুলে দেন শাহজাদার হাতে।

Advertisement

নিজের চেষ্টায় ইংরেজি, হিন্দু, অসমিয়া এমনকি বাংলাও শিখে নিয়েছেন শাহজাদা। পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে মহাশ্বেতা দেবী। কলকাতায় গেলে মহাশ্বেতা দেবীর বাড়িতে অবশ্যই যেতেন। বললেন, “রবিঠাকুরের কাবুলিওয়ালাদের মতো আর নেই এখনকার কাবুলিরা। তাঁরা আগের মতো দাড়ি রাখা, কাবুলি পোশাক পরা ছেড়েছেন। থাকেন নিজেদের গণ্ডিতে। অবশ্য টাকা ধার দেওয়ার কারবারটা এখনও চলছে।” শাহজাদার হিসেব বলছে, এখনও অন্তত তিন-চার হাজার আফগান অসমে রয়েছেন।

বড় সাধ করে ২০০৩ সালে বিশ্ব শান্তির উদ্দেশে বই লিখেছিলেন শাহজাদা। চার ভাষায় তা অনুবাদও করান। কাবুলিওয়ালার অসমিয়া ও বাংলা বই নিয়ে শোরগোল হয়েছিল তখন। লেখকের নামের সামনে শাহজাদা জুড়েছিলেন ‘মাটি’। কারণ জাত-পাঠান শাহজাদা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন মাটিতেই মানুষের উৎস, মাটিতেই ফের বিলীন হতে হবে।

কিন্তু নামের আগে থাকা মাটি তাঁর পায়ের তলার মাটি বাঁচাতে পারেনি। বইয়ের জন্য ভারত সরকারের সদ্ভাবনা পুরস্কার পেলেও, ২০১৭ সালে শাহজাদাকে বিদেশি হওয়ার দায়ে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যায় পুলিশ। অসমিয়া স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ের বাবা শাহজাদা বলছিলেন, “প্রথমে ভাবলাম কিছু একটা ভুল হচ্ছে। এখানে থাকা শুরু করার পরে একে একে লাইসেন্স, স্থায়ী আবাসিক শংসাপত্র, রেশন কার্ড, জমির মেয়াদি পাট্টা তো পেয়েইছি। এমনকি রয়েছে ভারতের ভোটার কার্ডও। চার বার ভোট দিয়ে সরকারও এনেছি।” সব প্রমাণপত্র আর ভারতের প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা মিথ্যে করে, ১৫ মাস বন্দি রাখার পরে, ২০১৮ সালে তাঁকে বিতাড়িত করা
হয় ভারত থেকে। জানতেন না, পরিবারের সঙ্গে আর কোনও দিন দেখা হবে কি না!

৩৭ বছর পরে দেশের মাটিতে পৌঁছে ভরসা হয়ে দাঁড়ান ছোটবেলার বন্ধু শাহওয়ালি। নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি টাকার জোরে রাতারাতি নতুন পাসপোর্ট তৈরি করে দেন বন্ধুর জন্য। পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে ভারতীয় দূতাবাস ভিসাও দেয়। কিন্তু আশপাশে তখন তালিবানি কড়া নজর। শাহজাদা জানান, রমজান মাস হওয়ায় বেলা পর্যন্ত ঘুমোত সবাই। সেই সুযোগে বন্ধু তাঁর পালানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁদের এলাকা এখন পুরো তালিবানের দখলে। বন্ধুকে ফোন করেছিলেন। কানে ভাসছে তাঁর আতঙ্কিত গলা।

ভারতে ফিরে অবশ্য ধর্ম বদলে খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছেন শাহজাদা। নামের আগে জুড়েছেন প্রিন্স। আশা করছেন, নতুন নাগরিকত্ব আইনে তাঁকেও নাগরিকত্ব দেবে ভারত সরকার। আর প্রতি বছর ভিসা পুনর্নবীকরণ করতে হবে না।

ভারত তাঁকে একবার বিতাড়িত করলেও এই দেশকেই নিজের নিশ্চিন্ত আশ্রয় বলে মনে করেন শাহজাদা। অবশ্য জানান, বই লেখার সময় থেকেই তালিবান তাঁকে হুমকি দিচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে তো বটেই দেশের ভিতরেও সর্বধর্ম সমন্বয়ের বই লেখা, ধর্ম বদল করার জন্য হুমকি ফোন পাচ্ছেন। পরোয়া করেন না শাহজাদা। জানান, এর পর পুশতু ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজে হাত দিচ্ছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement