(বাঁ দিকে) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং যোগী আদিত্যনাথ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
গত বছর জানুয়ারিতে যখন উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছিল, তখন তাঁকে কার্যত পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়ে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর ঠিক এক বছর পরে আগামিকাল সেই উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজ (এলাহাবাদ)-এ যখন মহাকুম্ভের আসর বসতে চলেছে, তখন সামনের সারিতে কেবল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বিশ্বনাথ করিডর থেকে রাম মন্দির নির্মাণ— অতীতে হিন্দুত্বের বার্তা দেওয়ার প্রশ্নে মোদীকে বারবার এগিয়ে আসতে দেখা গেলেও সেই হিন্দুত্বের মহাসঙ্গমে উল্লেখজনক ভাবে অনুপস্থিত তিনি। পরিবর্তে এ যাত্রায় প্রচারের যাবতীয় আলোয় শুধুই যোগী আদিত্যনাথ। হিন্দু সমাজের মুখ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার এই কৌশল তাঁকে দু’বছর পরে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী ও সর্বোপরি চার বছর পরে হতে যাওয়া লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার দৌড়ে অনেকাংশেই এগিয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতিকেরা।
এর আগে ২০১৯ সালে ইলাহাবাদে অর্ধ কুম্ভ হয়েছিল। যোগী তখন মাত্রই দু’বছর আগে ক্ষমতায় আসা মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এ যাত্রায় যখন সেই একই জায়গায় পূর্ণ কুম্ভ হচ্ছে, তখন তিনি দ্বিতীয় বার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে অনেক বেশি পরিণত। সামনেই হাতছানি রয়েছে প্রধানমন্ত্রিত্বেরও। তাই এই কুম্ভ মেলার মাধ্যমে মোদীর পরে নিজেকে হিন্দু সমাজের প্রধান মুখ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার কোনও সুযোগ ছাড়তে চাননি যোগী। বিশেষ করে গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরে মন্দির-মসজিদ বিতর্কের মাধ্যমে হিন্দুত্বের যে পথে চলার উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন, তাতে আরও গতি দিয়েছে মহাকুম্ভ। মন্দির-মসজিদ বিতর্ক কিংবা কড়া হিন্দুত্বের পথে চলা নিয়ে সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত পরোক্ষে যোগীকে সতর্ক করে দিলেও নিজের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার কোনও ইঙ্গিত দেননি যোগী। উল্টে মেলাকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মের উত্থানের ডাক, মুসলমান সমাজকে কুম্ভ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি। যাকে নীতিগত ভাবে সমর্থন জানিয়েছে কট্টর হিন্দু সংগঠনগুলি।
রাজনীতিকদের মতে, কুম্ভকে কেন্দ্র করে নিজের ধর্মীয় ও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতেও মাঠে নেমেছেন যোগী। সনাতন ধর্ম রক্ষায় উদ্যোগ ও কুম্ভের সুষ্ঠু আয়োজনের কারণে জ্যোতির্পীঠের শঙ্করাচার্য বাসুদেবানন্দ সরস্বতী যোগীর প্রশংসা করেছেন। আবার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ব্যক্তিগত ভাবে আমন্ত্রণ জানানোর কাজে লাগিয়েছেন মন্ত্রিসভার ৪০ জন সদস্যকে। বিশেষ ভাবে আবেদন জানানো হয়েছে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি ও দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ডের মতো বিরোধী রাজ্যগুলিকে। লক্ষ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গেই বিরোধী রাজ্যগুলিতেও নিজের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নিজেকে দল-মতের উপরে প্রতিষ্ঠিত করা।
রাজনীতিকদের একাংশের মতে, এ বারের কুম্ভমেলায় কেন্দ্রীয় সাহায্য অবশ্যই রয়েছে। তাই মেলাপ্রাঙ্গনে কেন্দ্র তথা প্রধানমন্ত্রীর অবদানের স্বীকৃতি থাকলেও গোটা মেলাটাই যে যোগীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। রাজনীতিদের বিশ্লেষণ, কুম্ভমেলাকে সফল করতে সব কেন্দ্রীয় মন্ত্রক এগিয়ে আসলেও কোনও কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রী যাতে কৃতিত্ব দাবি না করতে পারেন, সে দিকেও বিশেষ নজর রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা এসেছেন, কেন্দ্রীয় সাহায্য ঘোষণা করেছেন। কিন্তু কৃতিত্ব দাবি করার প্রশ্নে যোগী কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়েননি। যোগী-ঘনিষ্ঠ শিবিরের মতে, গত দু’বছর ধরে পূর্ণ কুম্ভ যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয়, সে দিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নজরদারি চালিয়েছেন যোগী। কারণ তিনি জানেন, এই মহামেলার আয়োজন সফল করতে পারলে, তা যেমন এক দিকে হিন্দুত্বের হাওয়া তুলে রাজ্যে তৃতীয় বার তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করার দিকে ঠেলে দেবে, তেমনই ২০২৯ সালে মোদীর পরে প্রধানমন্ত্রী পদ প্রার্থী হিসাবে তাঁর দাবিকেও পোক্ত করবে। তাই অন্য কেউ যাতে কৃতিত্বে ভাগ না বসাতে পারেন, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন যোগী। বিজেরপির একাংশের মতে, মূলত দলে গুজরাত অক্ষের যে প্রাধান্য রয়েছে, তা যদি গো-বলয়ের কেউ ভাঙতে পারেন, তা হলে তিনি যোগী আদিত্যনাথই। আর ওই অক্ষ ভাঙতে কুম্ভ মেলার সুষ্ঠু আয়োজনই শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হতে চলেছে যোগীর কাছে।
শুধু নিজের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা নয়, চলতি কুম্ভকে কেন্দ্র করে নিজেদের কোষাগার ভরে আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হওয়ার কৌশলও নিয়ে এগোচ্ছে যোগী আদিত্যনাথের সরকার। উত্তরপ্রদেশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কুম্ভের পরিকাঠামো খাতে ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে রাজ্য। উত্তরপ্রদেশ সরকারের অনুমান, আগামিকাল থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই মেলায় ৪০ কোটি ভক্তের আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি হিসাবে, প্রতি শরণার্থী যদি পাঁচ হাজার টাকা খরচ করেন, সে ক্ষেত্রে দু’লক্ষ কোটি টাকা আর ব্যক্তিপিছু গড়ে খরচ যদি দশ হাজার টাকা হয়, সে ক্ষেত্রে লেনদেনের পরিমাণ চার লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি হওয়ার কথা। উত্তরপ্রদেশ সরকারের এক কর্তার মতে, সরকার সব মিলিয়ে দু’-চার লক্ষ কোটি টাকার কেনাকাটা হতে পারে বলে আশা করছে। সরকারের গোটা বছরের জিডিপি-র প্রায় ৯ শতাংশ আয় ওই দেড় মাসের মেলা থেকে হবে বলেই আশা করছে রাজস্ব দফতর। যা রাজ্যকে আর্থিক ভাবে মজবুত করবে।